জয়পুরহাটে অনুমোদন ছাড়াই চলছে বেশির ভাগ ইটভাটা

মোঃ মোকাররম হোসাইন, জয়পুরহাট জেলা প্রতিনিধিঃ আইন লংঙ্ঘন করে যত্রতত্র ভাবে গড়ে উঠছে জয়পুরহাটে ইটভাটা। অনুমোদন ছাড়াই চলছে অধিকাংশ চুল্লি।এ জেলায় ৪৮ টি ইটভাটা চালু রয়েছে। এরমধ্যে মাত্র পাঁচটি ইটভাটার জেলা প্রশাসনের নিবন্ধন রয়েছে। জেলা প্রশাসনের নিবন্ধনহীন ওইসব ইটভাটাকে অবৈধ বলছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ব্যবসা-বানিজ্যে শাখা এ জেলায় কতগুলো ইটভাটা রয়েছে তার তথ্য দিতে পারেনি। হাইকোর্টের নির্দেশের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে তখন জয়পুরহাট জেলার চিত্র উল্টো। চলতি মৌসুমে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে কোনো অভিযানই চালানো হয়নি।

এসব অবৈধ ইটভাটায় অভিযান চালানোর জন্য জেলা প্রশাসনকে পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের জয়পুরহাট কার্যালয়েরর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ফারুক হোসেন।

জয়পুরহাট পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়ের ইটভাটার হালনাগাদ তালিকায় দেখা গেছে, এ জেলায় মোট ৪৮ টি ইটভাটা রয়েছে। এরমধ্য পাঁচটি ইটভাটার পরিবেশের ছাড়পত্র রয়েছে। এরমধ্যে দুটি ইটভাটার ছাড়পত্র নবায়ন করা হয়েছে। অন্য ইটভাটাগুলোর পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। ছাড়পত্র না থাকা ইটভাটাগুলোর অবস্থান গ্রহনযোগ্য নয় বলে হালনাগাদ তালিকায় উলে­খ করা হয়েছে।

২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৪ ধারা বলা আছে, ইটভাটা যে জেলায় অবস্থিত সেই জেলার জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতিত কোনো ব্যক্তি ইটভাটা স্থাপন ও ইট প্রস্তুত করিতে পারিবে না। তবে শর্ত থাকে যে, ব্লক প্রস্তুত করিবার ক্ষেত্রে এইরূপ লাইসেন্স এর প্রয়োজন হইবে না। ৮ (১) ধারায় বলা আছে, ছাড়পত্র থাকুক বা না থাকুক আইন কার্যকরের পর নিম্নবর্ণিত এলাকার অভ্যন্তরে কোন ব্যক্তি ইটভাটা স্থাপন করতে পারবেন না। (ক) আবাসিক, ব্যণিজ্যিক ও সংরক্ষিত এলাকা। (খ) সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর। (গ) সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধী বন, অভয়ারন্য, বাগান, জলাভ‚মি (ঘ) কৃষিজমি। ৮ এর ৩ (ঙ) ধারা বলা আছে, বিশেষ কোনো স্থাপনা, রেলপথ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, অনুরুপ কোন প্রতিষ্ঠান থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ভাটা স্থাপন করা যাবে না।

জেলার অন্তত ১০-১২ ইটভাটাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করে ইটভাটাগুলো স্থাপন করা হয়েছে। ইটভাটা ফসলি মাঠে স্থাপন করা হয়েছে। এসব ইটভাটা থেকে জনবসতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুরত্ব খুবই কম। তবে জেলার সবগুলো ইটভাটায় এখন জিগজ্যাগ চলছে।

জয়পুরহাট সদর উপজেলার বড় তাজপুর গ্রামে এইচ ব্রিকস ভাটার পাশেই ফসলি ক্ষেত রয়েছে। ৫-৬ গজ দুরত্বে বড় তাজপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। পাঁচবিবি উপজেলার ভীমপুর মের্সাস লিটন ব্রিকস ভাটা রয়েছে। সেখান থেকে ৩০০ গজ দুরত্বে রেললাইন ও ৬শ’ গজ দূরত্বে লোকালয় রয়েছে। জয়পুরহাট সদর উপজেলার ভারুরিয়া গ্রামে মের্সাস ভাই-ভাই ব্রিকস ভাটা থেকে আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।

পাঁচবিবির উত্তর কৃষ্ণপুর গ্রামে মের্সাস বেলী ব্রিকস ভাটার ২শ’ মিটার দূরে রেলাইন ও ৪শ’ মিটার দূরে জনবসতি রয়েছে। আক্কেলপুর পৌর এলাকার ভেতর ইটভাটা রয়েছে। ইটভাটাগুলো এলাকার বাসিন্দারা জানান, ইটভাটার কারণে ক্ষেতের ফসলের কিছুটা ক্ষতি হয়। ইট-মাটি পরিবহনের গ্রামীণ রাস্তার ক্ষতি হচ্ছে। নারকেল, আমগাছসহ বিভিন্ন ফলের গাছের ফল কমেছে।

বড় তাজপুর গ্রামের বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম বলেন, ইটভাটার কারণে ফসলি জমি কমে যাচ্ছে। এছাড়া ইটভাটার ধূলা-বালিতে তাঁদের সমস্যা হয়।

ভীমপুর এলাকার বাসিন্দা সাইদুর রহমান বলেন, ইটভাটার ধুলা-বালি উড়ে। এতে সমস্যা হয়। ফলের গাছের ফল কমছে। ইটভাটাগুলো বিভিন্নভাবে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি করছে। ইটভাটার বিরুদ্ধে প্রশাসনকে জানিয়ে লাভ হয় না। উল্টো ইটভাটার মালিক জানতে পারলে তার সঙ্গে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। একারণে ইটভাটা বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে চায় না।

একাধিক ইটভাটার মালিক ও ইটভাটার ব্যবস্থাপকরা জানান, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইনের নিয়ম মেনে এ জেলায় ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন করা কঠিন। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না পাওয়ার কারণে জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স মিলছে না। তাঁরা নিয়মিত আয়কর ও ভ্যাট দিচ্ছেন। প্রতি বছর জেলা ইটভাটা মালিক সমিতিতে নির্ধারিত হারে চাঁদা দিতে হয়। ইটভাটার মালিক সমিতি সবকিছু দেখভাল করে। একারণে তাঁদের খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হয় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইটভাটার মালিক বলেন, আমরা তো বৈধভাবে ইটভাটা চালাতে চাই। কিন্তু অবৈধ ইটভাটা থাকলে প্রশাসনের লাভ হয়। কি কারণে লাভ হয় তা তিনি জানাননি। জয়পুরহাট জেলা ইটভাটা মালিকক সমিতির সাধারণ স¤পাদক পারভেজ আহমেদ বলেন আমাদের বেশিভাগ ইটভাটার ২০১৫ সালের পর থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকায় জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স নবায়ন করা যায়নি। একারণে এখন বেশিভাগ ইটভাটা অবৈধ। তবে ইটভাটাগুলো মালিকেরা নিয়মিত প্রতি বছর আয়কর ও ভ্যাট দিচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জয়পুরহাট পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বলেন, জয়পুরহাট জেলায় মোট ৪৮ টি ইটভাটা চালু রয়েছে। এরমধ্যে পাঁচটি বৈধ।

অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত জয়পুরহাট জেলায় অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অবৈধ ইটভাটায় অভিযান পরিচালনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে জয়পুরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

জয়পুরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ব্যবসা-বানিজ্যে শাখার সহকারীর কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ রাজিব হোসেন বলেন, জয়পুরহাট জেলায় উজ্জল ব্রিকস, জয়নব ব্রিকস, শাকিল ব্রিকস, আরকে ব্রিকস ও সোহেল ব্রিকসের জেলা প্রশাসনের নিবন্ধন রয়েছে। এছাড়া অনিবন্ধিত ইটভাটার তালিকা তাঁদের কাছে নেই।

জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক (ডিসি) সালেহীন তানভীর গাজী বলেন, ইটভাটাগুলোর বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.