ফুলবাড়ীতে শিশু বয়সেই সংসারের বোঝা কাঁধে সেতুর ! হলুদ মরিচের গুঁড়ো বিক্রি করে পেটে জোটে অন্ন

এ আর রাকিবুল হাসান, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি: বাবার আঙুল ধরে হাঁটার কিংবা কাঁধে চড়ে খেলা করার সুযোগ হয়নি তার। হবেই বা কি করে। নানান রোগে আক্রান্ত বাবা যে তার শয্যাসায়ী। তবুও ঘরের মেঝে ও বাড়ির উঠানে খেলতে খেলতে শিশুটি ছুটে যেত শয্যাশায়ী বাবার কাছে। বাবাও রুগ্ন শরীরে পরম মমতায় ছেলেকে বুকে জরিয়ে কপালে, দু’গালে চুমু দিত। শয্যাশায়ী বাবার কাছে পাওয়া এতটুকু আদরেই খুশি ছিল শিশুটি। কিন্তু সে খুশি খুব বেশিদিন স্থায়ী ছিলনা শিশুটির ভাগ্যে। হঠাৎ একদিন সকালে পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি ভর্তি । মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে তার মা। তার ঠাঁই হয়েছে নিকটাত্মীয় এক মহিলার কোলে। বাড়িতে চলছে তার বাবাকে চিরবিদায়ের আয়োজন। বিকেলের দিকে শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া হয় বাবার খাটিয়ার কাছে। মুখের কাফন সরিয়ে শেষ বারের মতো দেখানো হয় বাবার মুখ। সেদিন সাঁঝে কঁঁচি হাতে বাবার কবরে মাটিও দিয়েছিল শিশুটি। এরপরে কেটে গেছে প্রায় পাঁচ বছর। শিশুটি এখন প্রাইমারির গন্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে পড়ে। পিতৃহারা শিশুটি বাস্তবতা বড়ই কঠিন। বর্তমানে বড়ভাই আর বিধবা মাকে নিয়ে তিন জনের পরিবারের খরচের জোগান দিতে হয় ওই শিশুটিকেই। হাতে বই খাতা কাঁধে তার সংসারের বোঝা।

বলছি- কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার চন্দ্রখানা গ্রামের শাহ বাজার এলাকার বাসিন্দা মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে ও শাহ বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র রবিউল ইসলাম সেতুর কথা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ দু’টি ঘর মিলে রবিউল ইসলাম সেতুর বসত বাড়ি। সেই বাড়ির উঠানে দেখা মিললো সেতুর মা ছামিনা বেগমের। স্বামীর মৃত্যুর পরে কিভাবে সংসার চলে জানতে চাইলে সামিনা বেগম বলতে লাগলেন, আমার স্বামী দিন মজুর ছিল। তাঁর আয়ে সংসার চলতো। দুই শিশু সন্তান রেখে তিনি মারা যান। এরপরে নিজের ও মাসুম বাচ্চা দুটোর মুখে দু’বেলা দুমুঠো খাবার তুলে দিতে মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ শুরু করি। যেদিন কাজ পাই সেদিন মুখে খাবার উঠে। কাজ না পেলে শুধু পানি খেয়েই দিন পার করতে হয়। ক্ষুধার জ্বালায় মাসুম বাচ্চা দু’টো যখন ছটফট করে তা দেখে বুকটা.. কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, এখন বাচ্চা দু’টো একটু বড় হয়েছে। বড় ছেলেটা নবম শ্রেণিতে এবং ছোট ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ছেলে সেতু লেখাপড়ার পাশাপাশি হলুদ মরিচের গুঁড়ো বিক্রি করে। সে প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে কখনো বাড়িতে বাড়িতে কখনো হাটে বাজারে হলুদ মরিচের গুঁড়ো বিক্রি করে সামান্য যা আয় করে তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন যাচ্ছে।

সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা পান কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বামী মারা গেছে পাঁচ বছর হলো। বিধবা ভাতার জন্য মেম্বার চেয়ারম্যানকে অনেকবার বলেছি লাভ হয়নি। আমার আশপাশের অনেকেই কত সরকারি সুবিধা ভোগ করছে। আমার কপালে কি কিছুই জুটবে না? স্কুলের মাস্টার মাঝে মাঝে বলে তোমার ছেলে দুইটা খুব মেধাবী। লেখাপড়া বন্ধ করে দিবেন না। এতো টানাটানির মধ্যে ছেলে দুইটা আর কতদিন লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারবে জানিনা। যদি সরকারি বা বেসরকারি কোন সাহায্য সহযোগিতা পেতাম তাহলে অন্তত ছেলে দুটোর লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারতাম।

শিশু বয়সেই সংসারের বোঝা কাঁধে নেওয়া সেতু মিয়া বলেন, মা অন্যের বাড়িতে, কখনো খেতেও কাজ করে। কাজ না পেলে উপোস থাকতে হয়। সেজন্য আমি হলুদ মরিচের গুঁড়ো বিক্রির কাজ শুরু করেছি। স্কুল থেকে ফিরে হলুদ মরিচের গুঁড়ো বিক্রি করতে বেড়িয়ে পড়ি। গুঁড়ো হলুদ মরিচ বিক্রি কোন দিন একশো, কোনদিন দুইশো টাকা লাভ হয়। সেই টাকা এনে মায়ের হাতে দেই। মা সংসারের কাজে খরচ করে। আমরা দুই ভাই খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করছি। লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করবো। তখন আর মাকে অন্যের বাড়িতে, খেতে খামারে কাজ করতে হবেনা। আমরা দু’ভাই মিলে মায়ের কষ্ট দূর করবো।

শাহ বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেলাল হোসেন বলেন, সেলিম মিয়া ও সেতু মিয়া দু’জনেই বেশ মেধাবী। পারিবারিক নানা সংকট মোকাবিলা করে তারা লেখা পড়া করছে। আমরা তাদের উপবৃত্তি সুবিধার আওতায় এনেছি। স্কুলে তাদের প্রতি বিশেষ নজর রাখা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.