অবৈধ ইটভাটাগুলো পরিবেশ-জীববৈচিত্র্যের বিপর্যয় ঘটালেও প্রশাসন নীরব!

মোহাম্মদ আককাস আলী, প্রতিনিধি মহাদেবপুর :  অবৈধ ইটভাটাগুলো পরিবেশ-জীববৈচিত্র্যের বিপর্যয় ঘটালেও প্রশাসন নীরব ভূমিকায় রয়েছে। কেন তারা পদক্ষেপ নিচ্ছেন না জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অধিকাংশ অবৈধ ইঁভাটাই ফসলি জমি নষ্ট করে তৈরি করা হয়েছে। আর তাতে পোড়ানো কাঠের কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষিত হওয়ার পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলায় গড়ে উঠেছে অবৈধ ইটভাটা। এমনকি বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ঘনবসতি এলাকার পাশেই কৃষি জমিতে ওসব অবৈধ ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আইন অনুযায়ী কৃষিজমিতে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইনে বলা আছে, আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে, বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটার এবং ইউনিয়ন বা গ্রামীণ সড়কের অন্তত আধা কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। আইন অমান্য করলে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড, অন্যূন ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।  কিন্তু আইন অমান্য করেই সারা দেশে ইটভাটা বাণিজ্য খেয়ালখুশিমতো চলছে। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওইসব অবৈধ ইটভাটাকে কোনো ধরনের দণ্ডের মুখোমুখি হতে হয় না। আবার কেউ যদি দণ্ডিত হন, পরে কৌশলে আবারো নতুন করে একই স্থানে ইটভাটা গড়ে তোলা হয়।
সূত্র জানায়, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র কিংবা জেলা প্রশাসকদের অনুমোদন ছাড়াই সারা দেশে প্রায় পাঁচ হাজার অবৈধ ইটভাটা গড়ে উঠেছে। ওসব ইটভাটার পাশে বসবাসকারীদের অভিযোগ, বছরের পর বছর ওসব অবৈধ ইটভাটা পরিচালিত হলেও বন্ধ করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। উল্টো প্রশাসনকে ঘুষ দিয়েই ইটভাটার মালিকরা এসব ভাটা পরিচালনা করছে। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে সারা দেশের অবৈধ ইটভাটার তথ্য চেয়েছে মন্ত্রণালয়। সেখানকার সর্বশেষ তথ্যে বলা হয়ছে, সারা দেশে চার হাজার ৮৩৬টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৭৩৩টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৮০১টি, খুলনা বিভাগে ৯৮১টি, রাজশাহী বিভাগে ৮২৪টি, রংপুর বিভাগে ৭৭৮টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৯২টি, বরিশাল বিভাগে ২০৪টি এবং সিলেট বিভাগে ২৩টি। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধের পদক্ষেপ নেয়া শুরু হয়েছে।
এদিকে ইটভাটা মালিকরা জানান, প্রশাসনকে ম্যানেজ করতে বছরে তাদের প্রত্যেককে ৪ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষের পেছনে খরচ করতে হয়। যার ইটভাটা যতো বড়, তার ঘুষের অঙ্কও ততো বেশি। এর বাইরে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্পন্সর করতে হয়। ওসব অনুষ্ঠানের আগে অবৈধ ইটভাটা মালিকদের কাছে টাকা চাওয়া হয়। তবে মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালিত হলেও আগে থেকে তাদের জানিয়ে দেয়া হয়। মূলত উপজেলা ও জেলা অফিসে একটি সিন্ডিকেট আছে। তাদের মাধ্যমেই বিষয়টি ম্যানেজ করা হয়। কখনো উপজেলা অফিসের কর্মকর্তাদের আত্মীয়-স্বজনকে কম দামে ইট দেয়া হয়, আবার কখনো বিনা মূল্যে। প্রতিটি জেলায় ইটভাটা মালিকদের সমিতি আছে। ওসব সমিতির মাধ্যমে প্রশাসনকে ম্যানেজ করা হয়।
অন্যদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনে (বিবিএমওএ) নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়সভা করেছেন। সভায় উপদেষ্টা জানান, ইটভাটাজনিত বায়ুদূষণ রোধে নতুন করে আর ইটভাটার ছাড়পত্র দেয়া হবে না। যেসব ইটভাটা পরিবেশ নষ্ট করছে সেগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করা হবে। পার্বত্য এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলো স্থানান্তরের কথাও জানিয়েছিলেন তিনি।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মাদ আব্দুল মোতালিব জানান, পরিবেশ অধিদপ্তর সব সময় কঠোর অবস্থানে রয়েছে। অবৈধ ইটভাটার ব্যাপারে অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হয়।
একই বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের  পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক জানান,  সারা দেশ থেকে অবৈধ ইটভাটার তালিকা সংগ্রহ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। গুরুত্ব বিবেচনায় ওসব ইটভাটা উচ্ছেদের কাজ শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে সব ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেয়া হবে। ওই লক্ষ্যে কাজ চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.