চাটমোহরে বাঁশ-বেতশিল্পের দুর্দিন

সিরাজুল ইসলাম আপন, পাবনা প্রতিনিধি: রাস্তার পাশে সাজানো রয়েছে বাঁশ। ঝাঁকা, কুলা, ডালা, চালনা, পলো, টোপা, টুকরি (আঞ্চলিক ভাষা) তৈরির জন্য পছন্দের বাঁশগুলো সঠিক পরিমাপে কড়াত দিয়ে কাটা হচ্ছে। অন্যদিকে রাস্তার পাড়ে, গাছের ডাল ও বিভিন্ন ভাবে ঝুঁলিয়ে রোদে শুকানো হচ্ছে বাঁশ থেকে তোলা চিকন বেতি। নানা গল্প আর শীতে মিষ্টি রোদে বসে ঝাঁকা, বেতি তোলা আর সাঁজি বুননের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন নারী পুরুষ শ্রমিকরা।

পাবনার চাটমোহর উপজেলায় ২ শতাধিক পরিবারের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন বাঁশের ও বেতের তৈরি পণ্য। উপজেলার অমৃতকুন্ডা, রতনপুর, কুবেরদিয়ার, মাঝগ্রাম, মির্জাপুর, হান্ডিয়াল, ছাইকোলা, গুনাইগাছা, হরিপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২ শতাধিক পরিবার বাঁশ ও বেতপণ্যের সাথে জড়িত। এ পেশাতেই চলে তাদের জীবন-জীবিকা। চাটমোহর উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের অমৃতকুন্ডা দাসপাড়ার প্রায় সকল পরিবারই এ পেশার সাথে জড়িত। নারী পুরুষ বাঁশ-বেত পণ্য তৈরিতে নিয়োজিত।

বাঁশ ও বেত দিয়ে কুলা, ডালা, চালনা, পলো, টোপা, তাল ছাকনা, মাছ ধরার খালই, ঝাঁকা, ঢাকনা (শরপেশ), ফুলের টব, তালাইসহ হরেক রকম পণ্যসামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে। দৈনন্দিন সাংসারিক কাজে ব্যবহৃত এসব পণ্য বিক্রি করতে দোকান খোলা হয়েছে। এছাড়াও বাঁশ ও বেতের তৈরি পণ্য ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে হাট-বাজারে। গ্রামে গ্রামে ফেরি করেও এসব পণ্য বিক্রি করছে।

এ পেশার সাথে জড়িত দাসপাড়া গ্রামের মহাদেব চন্দ্র দাস জানান, বাঁশ ও বেতের দাম অনেক বেড়েছে। তাছাড়া প্লাস্টিক পণ্য বাজার দখলে নিয়েছে। ফলে তারা বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। একই গ্রামের করুনা রানী দাস জানান, বিভিন্ন এনজিও থেকে তারা চড়া সুদে ঋণ পেলেও সরকারিভাবে বা ব্যাংকের মাধ্যমে সহজ শর্তে তারা ঋণ পান না। এনজিও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে তারা সর্বশান্ত হচ্ছেন। সহজ শর্তে ঋণ পেলে তাদের ব্যবসা ভালো করা যায়। তাদের আর্থিক সমস্যা দূর হলে কাজের পরিধি বাড়বে।

সরেজমিনে চাটমোহর উপজেলার রেলবাজার এলাকার দাসপাড়া গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। সংসারের যাবতীয় কাজ সামলে পরিবারের পুরুষ সদস্যের কাজে সহযোগিত করতে দেখা যায় নারী সদস্যদের। এমনকি কিশোর-কিশোরীরাও লেখা পড়ার পাশাপশি বাঁশ-বেতের কাজে সহযোগিতা করে থাকে। কেউ পছন্দের বাঁশ ধারালো দা দিয়ে পরিমাপ করে কেটে টুকরা করছে। এরপর সেই টুকরো বাঁশ থেকে বেতি তুলছে। আবার কেউ বেতি দিয়ে চাঙাড়ি, ঝাঁকা বুনছে। বাঁশ দিয়ে এসব সামগ্রী তৈরি করেই চলে তাদের জীবনসংসার। ওই গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার বাঁশ-বেতশীল্পের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল।

এ পেশার কয়েজন শ্রমিক বলেন, চাটমোহর সহ বিভিন্ন এলাকার হাট থেকে বাঁশ কিনে আনেন। তবে প্রতিটা বাঁশের দাম আগের চেয়ে বেশি। ভালো মানের একটি বাঁশের দাম পড়ে ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। আর একটি বাঁশ দিয়ে দুই থেকে তিনটি ঝাঁকা বানানো যায়। একেকটি ঝাঁকা বাজারে বিক্রি করা হয় ১০০ থেকে ১৩০ টাকায়। তারা আরো বলেন, দীর্ঘকাল ধরে আমরা এ পেশা করে আসছি, বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে আমরা জীবিকা নির্বাহ করছি। কালের পরিবর্তনে আধুনিকতার ছোয়ায় প্লাষ্টিক সামগ্রী দেশে ভরে গেছে। এখন এই পেশায় ধস নেমেছে আসছে।

বাঁশ দিয়ে পণ্য তৈরি করছেন এক নারী শ্রমিক লাকি রানী সে বলেন, বিয়ের পর থেকেই সংসারের কাজকাম শেষে স্বামীর বাঁশ-বেতের কাজে জোগান দিয়া আসছি। বাঁশের বেতি তুলা, রোদে বেতিগুলা শুকানো, ঝাঁকার চাক বান্দা, সাঁজিও বুনাই। বাঁশের চাকেই আমাদের জীবনসংসার।

পরিবেশবিদদের অভিমত, ক্ষতিকর প্লস্টিক পণ্যের ভিড়ে ঐতিহ্যবাহী ও পরিবেশ বান্ধব বাঁশ ও বেত শিল্প ধ্বংসের পথে। দিন দিন কমছে বাঁশ ও বেত শিল্পের সাথে জড়িতদের সংখ্যা। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।

এ বিষয়ে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক হান্ডিয়াল শাখার ব্যবস্থাপক মোঃ কামাল উদ্দিন বলেন, বিভিন্ন শ্রেনী পেশার উপর সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া প্রকল্প থাকলেও এধরনের প্রকল্পের বাজেট বর্তমানে না থাকায় ঋণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের পরবর্তী বাজেট আসলে এবং এ বিষেয়ে কেউ যোগাযোগ করলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.