পশ্চিমাদের মৌন সমর্থনই উস্কে দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা

রায়হান আহমেদ তপাদার, ইংল্যান্ড -লেখক, গবেষক ও কলামিষ্ট ঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তদানীন্তন পরাশক্তিদ্বয় মধ্যপ্রাচ্যে স্নায়ুযুদ্ধের উন্মুক্ত প্রান্তর গড়ে তোলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাশ্চাত্যে গঠিত ন্যাটো, মার্শাল পলান ও ট্রুম্যান ডকট্রিনের বিপরীতে সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে গঠিত ওয়ারশো প্যাক্ট ও কমিকনের মাধ্যমে পরাশক্তিদ্বয় মধ্যপ্রাচ্যে তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ বাস্তবায়নে নিরন্তর প্রয়াস চালায়। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তির অভাব, নেতৃত্বের শূন্যতা, বহির্বিশ্বে বিশ্বস্ত মিত্রের অপ্রতুলতা, নবগঠিত ইউএন কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার অসম নীতি প্রভৃতি কারণে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্র ও নাগরিকবৃন্দ স্নায়ুযুদ্ধের খপ্পরে পড়ে দিশেহারা হয়ে যায়। কিন্তু গত শতাব্দীর আশির দশকে অপ্রত্যাশিতভাবে কম্যুনিজমের পতন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনেরফলে মধ্যপ্রাচ্য পুঁজিবাদী পাশ্চাত্যের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমের প্রতিবন্ধকতাহীন জনপদে পরিণত হয়। উল্লেখ্য, অটোম্যান সাম্রাজ্য ভেঙে যাওয়ার পর আফ্রো-এশীয় আরব মুসলিমদের শিয়া-সুন্নি বিরোধ কাজে লাগিয়ে বিশ্ব শক্তিবর্গ নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধার করতে থাকে। বিশ্ব রাজনীতিতে সৌদি আরব সব সময়ই পশ্চিমাদের স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের আড়ালে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের যত রকমের চেষ্টা, সবকটিতে সৌদিদের ভূমিকা টের পাওয়া যায়। তাদের নতুন বাদশাহি নিয়ে কিছুদিন নানা রকম উচ্ছ্বাস থাকলেও সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার ঘটনা বুঝিয়ে দিয়েছে, সৌদি আরব তাদের কৌশলগত অবস্থান থেকে এতটুকুও নড়েনি।গত মে মাসে এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নিহত হওয়ার পর ইসরায়েলের হামলার ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। দ্রুত বিকাশমান প্রযুক্তিনির্ভর যুদ্ধের মধ্যে তথ্যসূত্রের অনিশ্চয়তা গুজব ও জল্পনা-কল্পনার আগুনকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

ইসরায়েলের এমন হামলার জবাব দিতে হিজবুল্লাহ ব্যর্থ হলেও সপ্তাহান্তে হিজবুল্লাহ যে তাৎক্ষণিক সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা লেবাননের সাধারণ মানুষ সমর্থন করেছে এবং তারা একে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো হিসেবে গ্রহণ করেছে।ইসরায়েলের রক্তাক্ত হামলা হাজার হাজার ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি জনসাধারণের সহানুভূতি বাড়িয়েছে এবং তাঁদের প্রতি পুরো দেশ সংহতি ও সমর্থন প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি ইসরায়েল লেবাননে নির্বিচার কয়েক দফা হামলা চালিয়েছে। তারা যোগাযোগ ব্যবস্থার ডিভাইসে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বৈরুতের উপকণ্ঠের দাহিয়েহ্ এলাকায় বিমান হামলা চালিয়েছে। এসব হামলাকে হিজবুল্লাহর ওপর বড় ধরনের আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে। বহুসংখ্যক বেসামরিক নিরীহ মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি এসব হামলায় হিজবুল্লাহর এলিট বাহিনী রাদওয়ান ইউনিটের শীর্ষস্থানীয় কমান্ডাররাসহ সংগঠনটির কয়েক ডজন যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। ইসরায়েল তাদের হামলার তীব্রতা আরও বাড়িয়েছে। এর অংশ হিসেবে তারা দক্ষিণ লেবানন এবং বেক্কা উপত্যকায় কয়েক দফা হামলা চালিয়ে এক হাজারের বেশি বেসামরিক লোক মেরে ফেলেছে। হিজবুল্লাহর যোগাযোগ নেটওয়ার্কে ইসরায়েলের ঢুকে পড়া এবং সংগঠনটির ওপরের সারির নেতাদের হত্যা করার ঘটনা হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ সক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। তাদের এই অবস্থান প্রতীকীভাবে হলেও হিজবুল্লাহর সঙ্গে তাদের এক ছাতার তলায় দাঁড় করিয়েছে। ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটির দুটি প্রাথমিক কৌশলগত লক্ষ্য হলো গাজা থেকে উত্তর ফ্রন্টকে বিচ্ছিন্ন করা এবং উত্তর ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত হওয়া কয়েক হাজার ইহুদিকে আবার সেখানে ফিরিয়ে নেওয়া। তবে এ দুটি লক্ষ্য এখনই ইসরায়েল পূরণ করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। হিজবুল্লাহর ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল নাইম কাসিম ঘোষণা করেছেন, যুদ্ধ আরও ‘উন্মুক্ত মাত্রায়’ প্রবেশ করেছে এবং এর ফলে আরও অনেক লোক বাস্তুচ্যুত হতে পারে।

হিজবুল্লাহর রকেট হামলায় ইসরায়েলের বেশ কয়েকটি শহর ফাঁকা হয়ে গেছে এবং সেখানকার কয়েক হাজার বাসিন্দা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র চলে গেছেন। এসব শহরের স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালগুলোকে তাদের কাছে চিকিৎসাধীন আহত ব্যক্তিদের ভূগর্ভস্থ নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলের হামলার পর ফিলিস্তিন, ইয়েমেন ও ইরাকে থাকা হিজবুল্লাহর মিত্রদের মধ্যে সংহতি জোরদার করেছে। তারা ইতিমধ্যেই বিবৃতি দিয়ে হিজবুল্লাহর প্রতি সমর্থনমূলক সামরিক পদক্ষেপের দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এটি সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, বর্তমান এই যুদ্ধকে কোনো বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ হিসেবে দেখা যাবে না। গোটা মধ্যপ্রাচ্যের খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। এক জায়গার ক্ষতি বা লাভের সঙ্গে অপর জায়গার ক্ষতি বা লাভ সংযুক্ত। হিজবুল্লাহ বারবার বলে আসছে, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের উত্তরের বসতিতে ফিরিয়ে দেওয়ার সর্বোত্তম উপায় হলো গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ শেষ করা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত মে মাসে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, অবৈধ ইসরায়েলি দখলদারি ও ভূখণ্ড অবরোধের অবসান এবং বন্দীদের মধ্যস্থতামূলক বিনিময়ের যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, হামাস তা মেনে নিয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল তাতে রাজি নয়। উত্তর ফ্রন্টে আচমকা গোলাগুলির মধ্য দিয়ে ইসরায়েলে এটি প্রকাশ করছে যে তারা একটি ন্যায্য ও যুক্তিসংগত সমাধানের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করায় আগ্রহী। তাহলে কী যুদ্ধকবলিত মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে। ফিলিস্তিনের গাজা গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর এবার লেবাননে নির্বিচার হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সম্প্রতি গাজা থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলে নজর ফেরানোর কথা জানিয়েছিল ইসরায়েল সরকার। এরই মধ্যে যোগাযোগ যন্ত্র পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর ভিত নাড়িয়ে দেয় ইসরায়েল। ওই ঘটনাকে হিজবুল্লাহর ওপর বড়ধরনের হামলার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে দেখা হচ্ছিল।

এরই মধ্যে গোটা লেবাননজুড়ে নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। সবচেয়ে বেশি হামলা হয় হিজবুল্লাহ অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলে। হামলার আগে হিজবুল্লাহর অবস্থান থেকে দূরে সরে যেতে বাসিন্দাদের বার্তা দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। লেবাননে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলাকে কয়েক বছরের সহিংসতার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিন বলে মন্তব্য করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর। একই সঙ্গে বেসামরিক লোকজনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের মুখপাত্র রাভিনা শ্যামদাসানি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন একবারেই স্পষ্ট। একটি সশস্ত্র সংঘাতে সব পক্ষকে অবশ্যই সব সময় বেসামরিক নাগরিক ও যোদ্ধা এবং বেসামরিক স্থাপনা ও সামরিক স্থাপনাকে পৃথক করতে হবে।’জেনেভায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার মুখপাত্র ম্যাথু সল্টমার্শ বলেন, লেবাননে ইসরায়েলের হামলার মধ্যে বেসামরিক নাগরিক নিহতের এই সংখ্যা অগ্রহণযোগ্য। তিনি আরও বলেন, হাজার হাজার মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এই সংখ্যা অব্যাহতভাবে বাড়ছে। সম্প্রতি হিজবুল্লাহর কমপক্ষে ১ হাজার ৬০০টি অবস্থানে হামলা চালানোর কথা জানিয়েছে ইসরায়েল। হামলা থেকে বাদ যায়নি রাজধানী বৈরুতও। এর জবাবে ইসরায়েলে দুই শতাধিক রকেট ছোড়ার দাবি করেছে হিজবুল্লাহ। পাল্টাপাল্টি এ হামলা ২০০৬ সালের যুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি। ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর পাল্টাপাল্টি হামলার জের ধরে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইসরায়েলের এই অপরাধের জবাবে ইরান নিশ্চুপ থাকবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচাই। রাশিয়া সতর্ক করে বলেছে, লেবাননে ইসরায়েলের হামলা মধ্যপ্রাচ্যকে পুরোপুরি অস্থিতিশীল করার এবং এ সংঘাতকে বিস্তৃত করার আশঙ্কা তৈরি করেছে। যদিও এ হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ক্রেমলিন।

লেবাননে হামলার নিন্দা জানিয়ে তুরস্ক বলেছে, গোটা মধ্যপ্রাচ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রয়াসে লেবাননে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং তাদের সমর্থন দেওয়া বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে আঙ্কারা। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপরোক্ত মন্তব্যের কারণেই তাঁকে পছন্দ করছেন না নেতানিয়াহু ও তাঁর কট্টরপন্থি সমর্থকরা। ওপরে ওপরে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে সদ্ভাব দেখালেও তাঁকে পছন্দ কিংবা সমর্থন- কোনোটাই করেন না নেতানিয়াহু। এই ইহুদিবাদী নেতা চান আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেন যাতে হেরে যান। তাহলে তাঁর (নেতানিয়াহুর) পক্ষে নিজস্ব গোপন কর্মসূচি বা নীলনকশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও হতে পারে। তবে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে নেতানিয়াহুর প্রতি জনগণের আস্থা কিংবা সমর্থন যেভাবে কমেছে, তাতে মনে হয় অবিলম্বে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নেতানিয়াহুর নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। বর্তমান সময়ে ইসরায়েলের নাগরিকরা মনে করেন,ইহুদি জনসাধারণকে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতা নেতানিয়াহু অনেক আগে হারিয়েছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি ধনকুবের গোষ্ঠী ও ইহুদিবাদী ‘প্রেসার গ্রুপের’ সমর্থন এখনো কিছুটা অবশিষ্ট থাকার কারণে নেতানিয়াহু প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নির্দেশ অগ্রাহ্য করার স্পর্ধা দেখিয়ে যেতে পারছেন। নতুবা আরো আগেই হয়তো তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হতো। সে কারণেই ইসরায়েল বিপদগ্রস্ত হলেই তাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন পাশে দাঁড়ায় এবং সেই সুযোগগুলো বারবার কাজে লাগায় ইসরায়েলের ইহুদিবাদী ও সম্প্রসারণবাদী নেতৃত্ব। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেনের সাফল্য দিন দিন আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে তার দ্বিমুখী কথাবার্তা এবং কূটনৈতিক দ্বিচারিতার জন্য। একই অবস্থা যুক্তরাজ্যের রক্ষণশীল দলীয় সরকারের। তারা এক মুখে গণহত্যা রোধ করার কথা বলছে, অন্যদিকে অর্থ এবং সীমাহীনভাবে অস্ত্র পাঠিয়ে মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ডে শরিক হচ্ছে। একই অপরাধে অপরাধী হচ্ছে। তবে যাই ঘটুক তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *