পৃথিবীর স্বর্গ পারস্যের ইস্পাহান

নবাবজাদা আলি আব্বাসউদ্দৌলা :-  ইরানের চারপাশ অসাধারণ আর অতুলনীয়। আর ইস্পাহান! তার তুলনা সে নিজেই। তাইতো দেশ-বিদেশের বিদ্বান ব্যক্তির গবেষণায় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেলের গবেষণাধর্মী অনুষ্ঠানগুলোতে বলা হয়ে থাকে… সমগ্র পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি সৌন্দর্য ইরানের ইস্পাহানে আছে। বিশ্বব্যাপী ভ্রমণের সৌভাগ্য সবার ক্ষেত্রে হয়ে উঠে না, যেমনটি আমার ক্ষেত্রেও হয়ে উঠেনি। ডিসকভারি চ্যানেল বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ইরানের ইস্পাহান ও তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে যেসব অনুষ্ঠান মালা তাদের চ্যানেলে প্রচার করেছে, তা দেখেই ইরানের ইস্পাহান ঘুরে দেখার শখ বহু আগ থেকে আমার মনে জন্ম নেয়। তাই বহুদিনের মনের জন্মানো ইচ্ছাপূরণে ইস্পাহান ভ্রমণে এলাম।

ইস্পাহানে প্রবেশ করেই মনে হলো সত্যি। এ তো ইরানের এক স্বর্গ রাজ্য। চারপাশ সবুজ আর সবুজ। গাছে গাছে রকমারি বাহারি ফুলের মেলা এ রাজ্যেই দেখা মেলে। ‘বুয়ে মাদারান’নামক দৃষ্টি নন্দন ছোট হলুদ ফুল সে অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকাগুলো দেখা যায়। বিশেষ করে মোরচাখোত পাহাড়ি এলাকায় এ ফুল দেখা যায় বেশি। পূর্বের দিনগুলোতে রাজা বাদশার আমলে ইস্পাহানকে দখল করতে আসা বাহিনীরা প্রথমে মোরচাখোতকে নিজের দখলে নিত, কারণ এখানে ছিল সেনানিবাস।

ইরানিরা ঘোরাফেরা করতে বেশ পছন্দ করেন। তাই দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে ইস্পাহানসহ অন্যান্য শহরে দৃষ্টি নন্দন অনেক পার্কের ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন সময়ে পর্যটক এবং ইরানি পরিবার-পরিজন খোলাবাতাসে সবুজের সান্নিধ্যে বেড়াতে আসেন।

পারস্য একটি মরুভূমির দেশ তাই এখানে গাছ গাছালি খুব সহজে জন্মায় না। এজন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে কৃত্রিম বনাঞ্চল সৃষ্টি করেছে, যাতে আবহাওয়ায় আর্দ্রতা সৃষ্টি হয় এবং মানুষ এই বনাঞ্চলে গিয়ে নিজের অবসর সময় গল্প আড্ডায় বা শুয়ে বসে আপনজন বা প্রিয়জনদের সাথে অতিবাহিত করতে পারে।

বন্ধুরা… সমগ্র ইস্পাহান দেখে মনে হলো সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শহর। এই সবুজ শহরে বাহারি সব ‘গোল’ (ফুল) এর দেখা মেলে। নাসরিন, নার্গিস, গোলাপ, ইয়াস, ‘গোল’গুলো তাদের বাহারি রূপ দেখার জন্য স্বাগতম জানাচ্ছিল অতিথিদের।

ইস্পাহানের সবুজ ছায়ার ডালে ডালে লুকিয়ে গুঞ্জন করছিল ‘ফারান্দে’(পাখি)-র দল। এই গুঞ্জনের আসর মাতিয়ে রেখেছিল থুথি (টিয়া), গোনজেসক (চড়–ই), কাফতার (কবুতর), পারাস্তু, কালাগ¦ (কাক)সহ অন্যান্য ফারান্দেরা। ইরানি কাক দেখতে বেশ আকর্ষণীয় এবং আমাদের দেশের কাকের মতো অকারণে কা-কা-কা করে না।

পাখিদের আড্ডায় ‘সাঞ্জাক্ব’(কাঠবিড়ালি) এর দল গাছের পাকা সু-স্বাদু ফল খেতে ব্যস্ত ছিল। ইস্পাহান শহরের প্রবেশদ্বার সড়ক চারবাগ আব্বাসির চারি পাশ সবুজ গাছপালায় ছেঁয়েছিল। চোখে পড়া উল্লেখযোগ্য বৃক্ষসমূহ : তুঁত, ভ্যান, সানোভার, নারভ্যান, বাগ-এ আঙুর, ফান্দুক (ফল), কাজ (অনেকটা ঝাউগাছের মতো), আনজির গাছ ( ডুমুর, তবে ইরানে ডুমুর ফল পাকলে হলুদ লালচের সমন্বয়ে মিশ্র রং ধারণ করে এবং তখনই খাওয়া যায়। খেতে সু-স্বাদু এবং মিষ্টি ) ইত্যাদি। ইস্পাহানের নাজবান গ্রাম সবুজে ঘেরা, ছোট ছোট দৃষ্টি নন্দন বাড়িঘর, পাশেই জায়েন রুদ নদীর স্রোত, নদীর স্রোতের পানির উপর ছোট বড় পাথরের স্তূপ, বড় পাথরের ওপর বসে নদীর স্রোতের পানিতে পা ভাসিয়ে মনটা সতেজ হয়ে উঠল। নদীর পাশেই ঘন জঙ্গল, জঙ্গলের পাশেই বিশাল আকারের উঁচু নিচু পাহাড়-পর্বত। নাজবান গ্রামে আরও দেখা মেলে আল বালুর (চেরি) ক্ষেত, সিভজামিনির (আলু) ক্ষেত, এই গ্রামেই অবস্থান করছে ইস্পাহান বার্ডস গার্ডেন, বার্ডস গার্ডেনের ভিতর না গেলে জীবনটা বুঝি বৃথাই হয়ে যেত। এত সব দৃষ্টি নন্দন পাখি এবং পাখির আবাস ভূমি ইতিপূর্বে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।

 পাখিগুলোর অধিকাংশই (৮০%) উন্মুক্ত অবস্থায় দর্শনার্থীর পায়ের কাছ দিয়ে হেঁটে গেয়ে আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দর্শনার্থীদের কেউ তাদের বিরক্ত করা বা ধরার চেষ্টা না করায় উম্মুক্ত পাখিগুলো অতিথি মানুষজনদের আপন করে নেয়। তাই দর্শনার্থী হিসেবে আমার পায়ের কাছে এসে দু’প্রজাতির ময়ূর পেখম খুলে তার নৃত্য পরিবেশন করলো। নানা প্রজাতির রাজহাঁস, পাতিহাঁস, কবুতর, মোরগ, মুরগি, উটপাখি, বক, ধনেশ, Victoria crowned pigeon, Grey crowned crane, Lapwing, Little Egret, Black headed Gull, Gallus Domesticus, Golden pheasant সহ আরও নাম না জানা রঙবেরঙের পাখিরা নিজ নিজ আঙিনায় আমন্ত্রিত দর্শনার্থী অতিথিদের সামনে হাসি খেলার বিনোদনে মাতিয়ে রেখেছিল।

“সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসা পেতে হলে, তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে”- এই কথায় ইরানিরা পূর্ণ বিশ্বাস রাখেন। তাইতো তারা পশু, পাখিকে বিরক্ত করা বা সবুজ গাছ পালার ডাল ও পাতা ভাঙা বা ফুল ফোঁটা ফুল গাছের ক্ষতিসাধন করে অকারণে ফুল ভাঙতে অভ্যস্ত নয় এবং সমগ্র ইরানের রওজা এবং তার আশপাশের এলাকা, বিমানবন্দরসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে শীতল ফিলটার পানি সকলের জন্য উন্মুক্ত। যা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কোথাও কোথাও পানি পানের জন্য একবার ব্যবহারযোগ্য নতুন গ্লাসও বিনামূল্যে দিয়ে থাকেন ইরান কর্তৃপক্ষ। দেখে মনে হলো আল্লাহর সৃষ্টির সেবা ও সম্মান করাই তাদের ধর্ম।

বন্ধুরা চলুন… কিছু ইরানি ভাষার সাথে পরিচিত হই : তুমান (টাকা), সিব (আপেল), নরাঞ্জি (কমলা), পুর্তাগাল (মালটা), মুজ (কলা), তুত ফারহাংগি স্ট্রবারি, আলু চে (কাঁচা ও সবুজ আলু বোখারা, টক ফল), হলু (অনেকটা আপেলের মতো দেখতে তবে আপেল নয়। খেতে সুস্বাদু টক মিষ্টি), কেইসি (হলুদ রঙের এই ফল পাকলে খাওয়া যায়, স্বাদে মিষ্টি), তুঁত, আনানাস (আমরা যাকে আনারস বলি), তালেবি, জায়তুন (জলপাই), কিভি।

ফলকে ইরানিরা ‘মিভে’বলে। এবার পশুপাখিকে তারা কি নামে ডাকে তা জেনে নি… হেইওয়ান (পশু), গাভ (গরু), গুস ফান্দ (ভেড়া), শোথর (উট), খার (গাধা), লাক লাক (বগ), থাউস (ময়ূর)। ইরানিরা বন্ধু বা প্রিয়জনকে বলে ‘জান’এবং ‘জানাম। কোনো কাজ ok হয়ে গেলে তারা বলে থাকে ‘বালে বালে’। ইরানিরা রুটি খেতে অভ্যস্ত তাই সেদেশের ক্ষেতখামারগুলোতে গমের ক্ষেতের দেখা মেলে। ‘মাজরায়ে গানদুম -এই নামে গমের ক্ষেত তাদের কাছে অতি পরিচিত।

ইরানিরা নিজ নিজ বৃক্ষের ফল একা একা খেতে অভ্যস্ত নয়, বৃক্ষের ৭০% ফলমূল পশু-পাখিদের খাবার জন্য ছেড়ে দেন। তবে বেশিরভাগ ইরানি নিজ আঙিনায় লাগানো বৃক্ষের সম্পূর্ণ ফল (অর্থাৎ ১০০%) টাই পশুপাখিদের খাওয়ার জন্য উন্মুক্ত করে রাখেন। তারা মনে করেন গাছের এই তাজা ফলমূলে পশুপাখিদের অধিকারটাই আগে। তাই তারা শখের গাছ গাছলার ফল না ভেঙে, বাজার থেকে ফলমূল কিনে খান এবং এভাবেই আল্লাহ তাআলার প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে থাকেন।

ইস্পাহানের দর্শনীয় স্থান ‘পুল-এ-খাজু- খুবই সুন্দর একটি স্থান, উক্ত স্থানে চোখে পড়ে অচেনা কিছু বৃক্ষ, আলাপ চারিতায় তাদের কাছে জানতে পারি বৃক্ষগুলোর নাম : ‘বিদ এ মাজনুন বৃক্ষ’, ফুলের গাছে হলদে ছোট ছোট ‘সুমবুল’ফুল ফুটে ছিল। পাশ দিয়েই প্রবাহিত মান জায়েন রুদ নদীর স্রোত। নদীর স্রোতে পা ভাসিয়ে গল্প আড্ডায় মেতে ছিল ইস্পাহানের কিশোর তরুণরা, পা ভাসিয়ে দেখলাম নদীর পানি অনেক স্বচ্ছ এবং শীতল।

ইস্পাহানের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানসমূহ : গুলহা গার্ডেন, Vank church,সিওসে পুল (এখানে কিশোর তরুণরা আনন্দ উল্লাসে বটিং করছিল), ৩৩ পুল, khwaju Bridge, ন্যাচরাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম (তাঁদের ইতিহাস ঐতিহ্যের অনেক বিষয়বস্তু উক্ত মিউজিয়ামে দেখা মেলে), Chehel sutun প্যালেসও মিউজিয়াম, বাগ-এ চাহেল সোতুন (দৃষ্টি নন্দন সব বাহারি ফুল, সবুজ বৃক্ষ আর নরম ঘাসের স্পর্শ, এর মাঝেই টাইলস বসানো শান্ত পুকুরের জলে পা ভাসিয়ে জল ছিটিয়ে মজা করার স্মৃতি মনে পড়ে), আলি কাপু প্যালেস, মসজিদে ইমাম খোমিনি ও শেখ লুৎফুল্লা (মসজিদটির বিশাল এলাকা জুড়ে বাগান আর মসজিদের বাইরের অংশে ইরানের ঐতিহ্যবাহী ঘোড়াগাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ব্যক্তিবিশেষ, যাত্রীবেশে অনেকেই ঘোড়া গাড়িতে ওঠার মজা লুফেছিলেন), মিনার জুমবান (দুইটা মিনার একটা গম্বুজ, উক্ত মসজিদের উপরে উঠে মিনারের চারপাশের ফ্রেম আকৃতির কাঠ ধরে ঝাঁকা দিলে উক্ত মসজিদটি বেশ ভালো রকম নাড়াচাড়া করে। পূর্বের দিনগুলোয় উক্ত মসজিদটির ঝাঁকুনিতে পার্শ্ববর্তী মসজিদও নাড়াচাড়া করত।), আতিশকু পাহাড় (এককালে এখানে অগ্নিপূজা করা হতো। বর্তমানে এই সু উচ্চ মাটির পাহাড়ে শিশু কিশোররা সাইকেলে চড়ে খেলাধুলায় মত্ত থাকে।), ফাদাক গার্ডেন, ইস্পাহান টেকনোলজি পার্ক।

ইস্পাহানের একটি পার্কে কৃত্রিম পাহাড়ি ঝর্ণার দেখা মেলে। ঝর্ণার পাশ ঘেঁষেই বিশাল আকৃতির ঝিল। ঝিলের পানির শাপলা শালুক পদ্মরা হাস্যোজ্জ্বল হয়ে স্বাগতম জানাচ্ছিল অতিথিদের। পৃথিবীর ৭০% সৌন্দর্য পারস্যের ইস্পাহানে, ইস্পাহান না দেখলে মানুষ মুখে প্রচলিত উক্ত কথাটি বিশ্বাসই হতো না। বন্ধুরা সত্যি! পারস্যের ইস্পাহান পৃথিবীর বুকে অনন্য এক স্বর্গ রাজ্য। এই স্বর্গ রাজ্য ভ্রমণে ইরান সকলকে জানাচ্ছে খোশ আমদেদ (স্বাগতম)।

Leave a Reply

Your email address will not be published.