কালাইয়ে তালোড়া-বাইগুনী চারমাথা হাট ২২ বছর প্রভাবশালীদের দখলে

মোঃ মোকাররম হোসাইন, জয়পুরহাট জেলা প্রতিনিধিঃ জয়পুরহাটের কালাইয়ে তালোড়া-বাইগুনী চারমাথা হাট ২০০১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ বাইশ বছর সরকারিভাবে এ হাট ইজারা দেওয়া না হলেও ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় প্রভাবশালীরা ইচ্ছেমত খাজনা আদায় অব্যাহত রেখেছেন এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর। পেরিফেরীর জটিলতার কারণে সরকার এ হাট থেকে গত ২২ বছরে প্রায় কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। উপজেলা প্রশাসনের তালিকায় এ হাট অন্তভূক্তি করে সরকারিভাবে ইজারা দেওয়ার দাবী করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী, হাটুরে ও এলাকাবাসী। তবে প্রশাসন বলছে ভিন্ন কথা। সীমানা জটিলতার কারনে এ হাট তালিকাভূক্ত হয়নি। আর সে কারনেই এ হাট ইজারাও দেওয়া যাচ্ছে না। আইনগত যত সমস্যাই থাকুক না কেন, আগামী বছর এ হাট তালিকাভূক্ত করে ইজারা দেওয়া হবে।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জনস্বার্থে উপজেলার তালোড়া-বাইগুনী চারমাথাতে একটি হাট বসানোর পরিকল্পনা ছিল স্থানীয়দের। কিন্তু জায়গার অভাবে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছিলনা।গত ২২/০৭/ ২০০১ সালে তালোড়া বাইগুনী গ্রামের দানবীর মরহুম মজিবুর রহমান ওই স্থানে হাট বসানোর জন্য ২০ শতক জমি ৪১২৭ নং দানপত্র দলিলমূলে লিখে দেন। এরপর থেকে প্রতি সপ্তাহে রোববার ও বুধবার ওই স্থানে হাট বসে। আর প্রতিদিন সেখানে বাজারও বসছে।

কিন্তু এ হাটের জায়গা উপজেলার উদয়পুর ও পুনট ইউনিয়নের শেষ সীমানায় হওয়ায় সীমানা নির্ধারণ নিয়ে জটিলতায় পড়েছেন উপজেলা প্রশাসন। এ নিয়ে দীর্ঘ ২২ বছর ধরে সমাধানে আসতে পারেননি তারা।দীর্ঘদিন ধরে এসব বেআইনি তৎপরতা প্রকাশ্যে চললেও প্রশাসন রহস্যজনকভাবে কেন নীরব ও নিষ্ক্রিয়,সেটাই স্থানীয় লোকজনের মনে প্রশ্ন! প্রশাসনের অদৃশ্য উদাসীনতার কারণে এই হাটটি পেরেফেরী না হওয়ার বাহানায় নিয়মিত খাজনা আদায় করে আসছেন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত থাকা কিছু অসাধু মহল। ওরা ‘স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র’। সে কারনে এ হাট ইজারাও দিতে পারছেননা প্রশাসন।

গত রোববার ছিল হাটবার। বিকেলে সরেজমিনে ওই হাটে গিয়ে দেখা যায়, আমিরুল ইসলাম ও আব্দুল মোতালেব নামে দুই ব্যক্তি হাটে ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করছেন। কথা হয় তাদের সাথে। তারা জানান, উদয়পুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক ইউপি সদস্য এনামুল হক লেবু, পুনট ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও সাবেক ইউপি সদস্য সাইদুর রহমান, একই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান ইউপি সদস্য আফজাল হোসেন এবং তার বোন জামাই আজাদ প্রামানিক মিলে দীর্ঘদিন ধরে এই হাট পরিচালনা করে আসছেন। আর তাদের হয়েই এ দুইজন হাটের খাজনা আদায় করছেন। মাসিক বেতনে তারা এ কাজ করছেন।তাদেরকে যে হারে খাজনা আদায় করতে বলেছেন, সেভাবেই আদায় করছেন।

হাটের ধান ব্যবসায়ী ও আড়ৎদার মাসরেকুল রানা বলেন, শুরু থেকেই এ হাট সরকারিভাবে ইজারা দেওয়া হয়নি। কিন্তু ক্ষমতার দাপটেই তারা ঠিকই খাজনা আদায় করছেন। গত এক মাসে আমার আড়ৎ থেকে প্রায় ৩০ ট্রাক ধান লোড দেওয়া হয়েছে। তাতে ৬০ হাজার টাকা শুধু খাজনা বাবদ তাদের দিতে হয়েছে। অন্যরাতো আছেই।মাছ, মাংস,কাঁচা বাজার, দুধের বাজার, স্থায়ী দোকান থেকে প্রতিদিন খাজনা আদায় চলছেই। প্রতিবাদ করতে গেলেই দ্বন্দ্বে জড়াতে হয়। তাই আর কেউ ভয়েই প্রতিবাদ করে না।

হাট এলাকায় স্থায়ী বাসিন্দা হবিবর রহমান বলেন, এ হাট থেকে গড়ে প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা খাজনা আদায় হয়। পুরো টাকাই নামধারী ইজারাদারদের পকেটে যায়। অথচ সরকার এই হাটের ইজারা থেকে একেবারেই বঞ্চিত। গত ২২ বছরে এ হাট থেকে কমপক্ষে এক কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।

পুনট ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও সাবেক ইউপি সদস্য ওই হাটের কথিত ইজারাদার সাইদুর রহমান বলেন, খাজনা আদায়ের ঘটনা সত্য। বর্তমানে আমরা চারজন মিলেই খাজনা আদায় করছি। তবে গত বছরগুলোতে অন্যরা খাজনা আদায় করেছে। যা আদায় করা হয়, তা থেকে কর্মচারীদের বেতনও দেওয়া হয়। এছাড়া হাটের মসজিদ ও এতিমখানায়ও টাকা দেওয়া হয়। তবে আলু ও ধানের মৌসুমে পুনট এবং মোসলেমগঞ্জ হাটের ইজারাদাররা পৃথকভাবে সীমানার বলে এ হাট থেকে খাজনা আদায় করেন।

আরেক কথিত ইজারাদার উদয়পুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক ইউপি সদস্য এনামুল হক লেবু বলেন, দুই ইউনিয়নের শেষ সীমানায় এ হাট বসার কারণে এতো ঝামেলা হচ্ছে। খাজনা আদায়ে যে টাকা পাওয়া যায় তা সবাইকে ভাগও দিতে হয়।আবার দোষও হয় আমাদের। আমরা চাই এ হাট দ্রুত সরকারিভাবে ইজারা দেয়া হউক। তাহলে একটা নিয়মের মধ্যে পরিচালিত হবে।

তবে পুনট হাটের ইজারাদার নাসির উদ্দিন এবং মোসলেমগঞ্জ হাটের খাস কালেকশনের ইজারাদার রায়হান উদ্দিন জানান, নিয়ম আছে একটি হাটের এক কিলোমিটারের বাহিরে কোনো খাজনা আদায় করা যাবেনা। তালোড়া-বাইগুনী হাট থেকে এ দুটি হাটের দুরত্ব ৪/৫ কিলোমিটারেরও বেশী। তাতে প্রশ্নই ওঠে না এক হাট থেকে অন্য এলাকার হাটে গিয়ে খাজনা আদায় করার।ওরা নিজেরা অন্যায়ভাবে খাজনা আদায় করে অন্যদের উপর দোষারুপ করছেন।

হাটের জমিদাতা মরহুম মজিবুর রহমানের ছেলে মাহবুবুর রহমান বলেন, জমি দানকারী আমার বাবা। যতদিন এ হাট ইজারাভূক্ত হয়নি ততদিন আমরাই খাজনা আদায় করতে পারতাম। কিন্তু কই, আমরা না করলেও অন্যরা ঠিকই খাজনা আদায় করছেন। খাজনা আদায়কে কেন্দ্র করে এ হাটে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। ইজারা দিয়ে এ হাট পরিচালনা করতে প্রশাসনের নিকট অনুরোধ করেছেন তিনি।

অবৈধভাবে খাজনা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জান্নাত আরা তিথি বলেন,‘কেবলমাত্র সরকারই হাটবাজার ইজারাদানের মালিক। আমার জানামতে, দুই ইউনিয়নের শেষ সীমানায় এ হাটটির অবস্থান। এই হাটটির পেরি ফেরী নির্ধারণ না হওয়ায় সরকারিভাবে ডাক দেওয়া সম্ভব হয়নি। আশা করি,কোষাগার যেন লক্ষ লক্ষ টাকার রাজস্ব বঞ্চিত আর না থাকে,সেজন্য সরকার আর দেরি না করে অবিলম্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।এবং অবৈধভাবে খাজনা আদায় যেন আর না করতে পারে সে বিষয়ে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।

Leave a Reply

Your email address will not be published.