জয়পুরহাটে পাটের দাম কমায় হতাশ হয়ে পড়েছে কৃষকরা

মোঃ মোকাররম হোসাইন, জয়পুরহাট জেলা প্রতিনিধিঃ বাংলা মাটি ও মানুষের শতবর্ষের ঐতিহ্য পাটকে বলা হয় সোনালী আশঁ।জয়পুরহাটের পাঁচটি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে কৃষকদের মুখে হাসি নেই। আর এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে প্রতি বছরের মতো এবছর জেলাতে পাট চাষাবাদ করেছেন কৃষকরা। পাটের ভালো ফলন না হওয়া ও ন্যায্যমূল্য না পাওয়াই এ জেলার কৃষকরা হতাশ হয়ে পড়েছে। কৃষকরা অনেক আশা নিয়ে পাট চাষ করেছেন। কৃষকরা আরও জানান হাটবাজার গুলোতে সিন্ডিকেট করে পাটের দাম কমানো অভিযোগ উঠেছে, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে।কৃষকরা পাটের ন্যায্যমুল্য পেতে প্রশাসনের নিয়মিত বাজার তদারকি প্রয়োজন বলে মনে করছেন।

গত বছর পাটের বিক্রি করছি ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা দামে প্রতি মণ পাট বিক্রি করেছি। কিন্তু এবার পাচ্ছি ২ হাজার থেকে২ হাজার ১০০ টাকা পর্যন্ত পাট বিক্রি করছি। তাছাড়া এবার উৎপাদনও কম। ফলে দাম কম কৃষকরা বলেন, এই দামে পাট বিক্রি করলে আমাদের লোকসান হবে।’

আব্দুল মান্নান পাঁচবিবি উপজেলার কোতয়ালীবাগ এলাকার কৃষক বলেন।তিনি এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করে এবার লাভ নয়, খরচ তোলার হিসাব করছেন।তিনি আরও বলেন সারের দাম কম পাব। পাটের দাম ঠিক মতো পাব।তাহলে আমরা কৃষকেরা চলতে পারব।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সুত্রে জানা গিয়েছে যে, এবার জয়পুরহাট জেলায় ৩ হাজার ১১৮ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। চলতি বছরের খরিপ-১ মৌসুমে জেলায় ৩ হাজার ৫৭০ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৫২ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ কম হয়েছে। গত মৌসুমে ৩ হাজার ৪৯৫ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। গত মৌসুমের তুলনায় এবার ৩৭৭ হেক্টর জমিতে এই ফসলের আবাদ কমেছে।

গত মৌসুমে ৮ হাজার ৪২০ মেট্রিক টন পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও উৎপাদন হয়েছে ৭ হাজার ১৫৮ মেট্রিক টন। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ২৬২ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন কম হয়েছে। এবার ৮ হাজার ৫৬০ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

এ বছর সদর উপজেলার ১ হাজার ৩৫০ হেক্টর, পাঁচবিবি উপজেলায় ১ হাজার ৪৬০ হেক্টর, কালাই উপজেলায় ২৪৫ হেক্টর, ক্ষেতলাল উপজেলায় ৫০ হেক্টর ও আক্কেলপুর উপজেলায় ১৩ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। গত মৌসুমে ৮ হাজার ৪২০ মেট্রিক টন পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও উৎপাদন হয়েছে ৭ হাজার ১৫৮ মেট্রিক টন। এই মৌসুমে ৮ হাজার ৫৬০ মেট্রিক টন পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৯৫ শতাংশ পাট কর্তন করা হয়েছে।

রিপন হোসেন কৃষক বলেন, ৫৫ শতক জমিতে পাট চাষ করেছেন। তিনি বলেন, এই মৌসুমে পাট চাষে খরচ বেশি হয়েছে। এবার এক বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে ১৬ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে। আর এ বছর বৈরী আবহাওয়ার কারণে পাটের ফলন কম হয়েছে। এই দামে বিক্রি করে পাট চাষ করা যাবে না। কেননা প্রতি বিঘায় এবার ৮ থেকে ৯ মণ পাট উৎপাদন হয়েছে। যার মুল্য হচ্ছে ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি। এতে এক থেকে দেড় হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষকে। সেই হিসেবে পাট চাষ করা লোকসানের ফসল হয়ে যাবে।

আব্দুল করিম বলেন, কম পক্ষে ৩ হাজার টাকা পাটের মণ থাকা লাগবে। তাহলে কৃষকের লাভবান হবেন।২০আঁটি পাট কাটতে লাগছে ৬০০ টাকা। ওই ২০ আঁটি পাটে এক মণ পাট হবে। তাহলে ২ হাজার টাকায় পাট বিক্রি করে কাটার খরচ ৬০০ টাকা বাদ দিলে ১ হাজার ২০০ টাকা থাকছে। আবার ওই পাট ধুতে ৫০০ টাকা।

হামিদুল হক রতনপুরের পাট ব্যবসায়ী বলেন, প্রতি বছর ৯০০ থেকে এক হাজার মণ পাট কেনা হয়। এবারও একই পরিমাণ পাট কেনা হবে। বর্তমানে প্রতি মণ পাট ২ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় কেনা হচ্ছে। তবে ২ হাজার ১৫০ টাকা দামে পাট বেশি কেনা হয়েছে। কৃষকদের কাছ থেকে কেনার পর প্রতি মণে ৫০ টাকা বেশি দরে এই পাট আবার বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছি। এই ৫০ টাকার মধ্যে শ্রমিক মজুরি বাবদ ৪০ টাকা খরচ হচ্ছে। আর প্রতি মণে লাভ থাকছে ১০ টাকা।

আনোয়ার হোসেন সদর উপজেলার বিষ্ণপুর এলাকার পাট ব্যবসায়ী বলেন, আমি গত বছর এক হাজার মণ পাট কিনেছিলাম। পাটের দাম পড়েছিল ২ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা। ওর মধ্যে কিছু পাট বিক্রি করেছিলাম। পরে পাটের দাম কমতে শুরু করতে ২ হাজার ৬০০ টাকা মণ দরে পাট বিক্রি করেছি। এতে লোকসান হয়েছে। এবার এখনো পাট কেনা হয়নি। তবে ব্যবসা ধরে রাখার জন্য ২০০-৩০০ মণ পাট কিনতে পারি।

জয়পুরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (পিপি) মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, এ জেলায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পাটের আবাদ কিছুটা কম হয়েছে। আবহাওয়া প্রতিকূলে থাকায় এই ফসলের আবাদ কমেছে। তাছাড়া কৃষকেরা সবজি চাষের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে । যাতে পাটের আবাদ বৃদ্ধি পায় তাই কৃষি বিভাগ থেকে যাবতীয় সহযোগিতা এবং পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, চাষিরাও পাট চাষে আগ্রহী হচ্ছেন না। কারণ বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে পাট রোপণ ও জাগ দেওয়ায় সমস্যা হয়েছে। আবার শ্রমিকের মজুরিও বেশি। সেই অনুযায়ী কৃষকেরা পাটের মূল্য পাচ্ছেন না।

আব্দুল হাকিম পাট অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের মুখ্য পরিদর্শক বলেন, জেলার দুই উপজেলায় বেশি পাটের আবাদ হয়। আর বাকি তিন উপজেলায় পাট চাষ কম হয়। গত বছরে কৃষকের অনেক পাট ব্যবসায়ী কেনার পর মজুত করার কারণে এ বছর পাটের দাম অনেক কম।গত বছরের অনেক পাট এখনো ব্যবসায়ীদের কাছে মজুত আছে। তাই ব্যবসায়ীরা এবার পাট কম কিনছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.