দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মকর্তা’র দুর্নীতির কাব্য – উপ-পরিচালক মাহাবুবুল আলম এবার কাঠগড়ায়

নিজেস্ব প্রতিনিধিঃ  অভ্যন্তরীণ তদন্তে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক মুহ. মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি।

মাহবুবুল আলম দুদকে ২৮ বছর আগে পরিদর্শক পদে যোগ দেন। এর পর পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন উপ-পরিচালক। তিনি বর্তমানে কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-২ এ কর্মরত রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত দুর্নীতিবাজদের অব্যাহতি দেওয়ার বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে।

তার বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্য ও ইয়াবা কারবারের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের অভিযোগ আমলে নিয়ে বুধবার অনুসন্ধান দল গঠন করেছে কমিশন। দুদক পরিচালক শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধান দলের অন্য দুই সদস্য হলেন উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক নেয়ামুল গাজী। বৃহস্পতিবার এ খবর জানাজানি হলে সংস্থার ভেতরেই তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দুদক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, দুদকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ এলে শুরুতে ‘ইন্টারনাল’ তদন্ত হয়। তার (মাহবুবুল আলম) বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর গোপন তদন্ত করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান দল টিম গঠনের বিষয়টি আমার জানা নেই।

দেশের খ্যাতনামা এক সংবাদমাধ্যম মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে মরণনেশা ইয়াবা কারবারে জড়িত থাকার মত গুরতর অভিযোগ এনেছে । চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনকালে টেকনাফ থেকে ইয়াবার চালান এনে বরগুনা ও বরিশাল এলাকায় সরবরাহ করেন। মাদক বাণিজ্যের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন তিনি।

এছাড়া তার বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অভিযোগগুলো হলো-চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এ কর্মরত থাকাকালে তিনি ঘুষ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর ট্র্যাপ কেসের মাধ্যমে মহেশখালী সদর উপজেলার কানুনগো আবদুর রহমানকে নগদ টাকা ও বিপুল পরিমাণ স্ট্যাম্পসহ গ্রেফতার করা হয়। ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসাবে তিনি জব্দ করা টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দেন। তিন বছর পর আদালতের নির্দেশে ওই টাকা জমা দেন। অথচ জব্দ করা ওই টাকা ছিল ফাঁদ মামলার আলামত।

এছাড়া দুদকের চাকরিচ্যুত আলোচিত কর্মকর্তা শরীফ ২০২১ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম থেকে বদলি হওয়ার পর তার আলোচিত প্রতিবেদনগুলো চার মাস নিজের কাছে রেখে দেন মাহবুবুল আলম। ওইসব প্রতিবেদন মোটা টাকার বিনিময়ে তিনি মামলার আসামিদের কাছে সরবরাহ করেন বলে অভিযোগ আছে । আসামিদের কাছ থেকে নেওয়া বিপুল অঙ্কের ঘুষের টাকায়ই তিনি তখন পটুয়াখালী ও ঢাকায় সম্পদ কেনেন। তার অবৈধ সম্পদের সত্যতা দুদকের গোপন তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে বলে জানা গেছে।

অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদের ৯০ ভাগের মালিক হন চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এ চার বছর কর্মরত অবস্থায়। শুধু তাই নয়, কেজিডিসিএল-এর মামলার সুপারিশ করা প্রতিবেদন পরিসমাপ্তির সুপারিশ করে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা হিসাবে আসামিদের কাছ থেকে তিনি বিপুল অঙ্কের ঘুষ নেন বলে জানা যায়।

অভিযোগ আছে, বর্তমানে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত এই কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানের জন্য রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে চিঠি দেয় দুদক। কিন্তু মাহবুবুল আলম প্রভাব খাটিয়ে সেটিও আটকে দেন। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পাঠানো চিঠিতে কমিশন তার যে পরিমাণ অবৈধ সম্পদের কথা উল্লেখ করেছে, তার চেয়ে অনেক কম অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ায় দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও দুদুক নিজেদের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখিয়েছে ।

এছাড়া তার বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ হলো-লোহাগড়ার সাবেক ওসি শাহজাহানের বিরুদ্ধে সম্পদের অনুসন্ধান দলের প্রধান হিসাবে অনুসন্ধানটি নথিভুক্ত করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শাহজাহানের কাছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছিলেন । শাহজাহান বাধ্য হয়ে মাহাবুবুল আলমের কক্সবাজারের এজেন্ট মুবিনের মাধ্যমে ঢাকার শান্তিনগর বাসায় দুদফায় ৭২ লাখ টাকা পৌঁছে দেওয়া হয় । কিন্তু দাবি করা ঘুষের পুরো টাকা না পেয়ে রতন কুমার দাসকে দিয়ে শাহজাহানের বিরুদ্ধে মামলা করিয়ে দেন।

এছাড়া ২০১৯ সালে ট্র্যাপ কেসের মাধ্যমে চট্টগ্রাম এলএ শাখার চেইনম্যান নজরুলকে নগদ ৮ লাখ টাকা ও বিপুল পরিমাণ এলএ চেকসহ গ্রেফতার করা হয়। তিনি ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার কথা থাকলেও অবৈধ সুবিধা নিয়ে চার বছর ধরে তিনি মামলাটি আটকে রাখেন।

এছাড়াও ঢাকায় কর্মরত থাকাকালীন সময়ে ২০১৬ সনে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের বেশ কিছু মামলা অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান । সেই সময় ব্যাংকের এমডি এবং এডিশনাল এমডি’র মধ্যে আভ্যন্তরীন দ্বন্দ চলমান ছিল । এমডি ও চেয়ারম্যানের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে কোনরুপ অনুসন্ধান ছাড়াই বেশ কিছু ব্যাংক কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করে দুদুক অফিসে বসিয়ে রেখে মামলা দায়ের করেন ।

এরপর আর্থিক সুবিধা নিয়ে ঋন কমিটির ৭ জনকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র তিনজনকে চার্জশিটে অভিযুক্ত করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে । ব্যাংকের এমডি , চেয়ারম্যান, ঋন কমিটি সহ উর্ধতন দায়ীদের বাদ দিয়ে সুইফট অপারেটর, ঋন প্রস্তাব প্রেরণকার , ঋন প্রস্তাব প্রস্তুতকারক এই ধরনের নিম্নস্তরের কর্মকর্তাদের আসামী করে চার্জশিট দাখিল করেন ।

মাহবুবুল আলম দুর্নীতি, ঘুষ গ্রহণ, অনৈতিকভাবে অর্জিত অর্থে নিজ নামে, স্ত্রী, মেয়ে ছাড়াও নিকটাত্মীয়র নামে রাজধানীর শান্তিনগর ও রামপুরায় বহুতল ভবন, ফ্ল্যাট, দোকান, গাড়ি, বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ, বরগুনার আমতলী উপজেলায় তার গ্রামে কয়েকশ বিঘা জমিসহ অঢেল সম্পত্তি গড়ার অভিযোগ রয়েছে। এ সব অভিযোগের বিষয়ে অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান চালায় দুদক। তিন বছর অনুসন্ধান শেষে বেশকিছু অভিযোগের প্রমাণও মিলেছে। তবে তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অনুসন্ধান প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়নি বলে মনে করছে দুদক। ফলে কমিশন থেকে আরও অধিকতর তদন্তের জন্য এবার তিন সদস্যের কমিটি গঠন করল।

দুদকে অভিযোগ পড়ার পর তার বিরুদ্ধে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও অভিযোগ জমা পড়ে। এরপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে অভিযোগের সংশ্লিষ্ট নথিপত্র দুদকে পাঠিয়ে এ বিষয়ে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিতকরণের অনুরোধ জানানো হয়। পরে ওই অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের পরিচালক মুহাম্মদ ইউসুফকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে একই ধরনের আরেকটি অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। তিন বছর অনুসন্ধান শেষে গত ২৪ জানুয়ারি প্রতিবেদন দাখিল করেন তিনি।

দুদকের অভ্যন্তরীণ সেই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মাহবুবুল আলমের নামে দান ও কেনাসূত্রে ১৮টি দলিলে ৪৫৫ শতক জমি এবং ২০ লাখ ১ হাজার ৩০০ টাকা বিনিয়োগসহ ২৯ লাখ ৮৩ হাজার ৫৯১ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। এ ছাড়া পটুয়াখালীর গলাচিপা আড়তপট্টিতে ছয়টি দোকান কিনেছেন তিনি। গ্রামে এক কোটি ৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা মূল্যের কৃষি জমি রয়েছে তার।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাহবুবুল আলমের স্ত্রীর নামে ১৪টি দলিলে ৩৫৪ শতক জমি কেনার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া একটি কোম্পানিতে পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়েছে। তার মেয়ের নামেও সাতটি দলিলে ১৪৫ দশমিক ৮৮ শতক জমি, ২৬ লাখ টাকার গাড়ি কেনা ছাড়াও পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগসহ অন্যান্য সম্পত্তি থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে দুদুকে জমা পড়া এক অভিযোগে বলা হয়েছে, পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় তার জমি ও তিন তলা একটি ভবন রয়েছে। এছাড়া বরগুনার আমতলীর সোনাখালী গ্রামে তার বসতবাড়িতে দুই তলা ভবন, পটুয়াখালীর পায়রাবন্দরের পাশে কলাপাড়ায় কয়েকশ বিঘা জমি, আমতলী উপজেলায় কয়েকশ বিঘা ধানী জমি ও তিনটি দীঘি, ঢাকার শান্তিনগরে তার টাকায় ভাগ্নি জামাই হাবিবুর রহমানের নামে সাত তলা এবং রামপুরায় ছয় তলা ভবন রয়েছে।

অন্যদিকে, নয়াপল্টন এলাকায় চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী নামে ২০ তলা মার্কেটে ভাগ্নি জামাই হাবিবুর রহমানের নামে শেয়ার, আমতলী উপজেলায় বাড়ি, হাবিবুর ও তার ছেলের নামে নতুন-পুরাতন গাড়ির শো-রুম, মিরপুরে দীপ্তি আবাসন প্রকল্পের নিকট আত্মীয়ের নামে শেয়ার, সেখানে মালিক দেখানো হয়েছে ফারুক মৃধা, নজরুল ও মশিউরসহ আরও কয়েকজনকে। এ ছাড়া বোন, বোন-জামাই, ভাগ্নে-ভাগ্নিদের নামে, শ্যালক ও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নামেও ঢাকা ও পাবনায় শত শত বিঘা জমি কিনেছেন। বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শত কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে তার।

অভিযোগে তার বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। আরও বলা হয়, তার নিজ উপজেলা আমতলীর একটি স্কুল ও কলেজে অ্যাডহক কমিটির সভাপতি পদ নিয়েও তিনি আইন-বহির্ভূত প্রভাব খাটাচ্ছেন।

এত অভিযোগ এবং তা প্রাথমিকভাবে প্রমানিত হওয়া স্বত্বেও মুহা. মাহবুবুল আলম এখনও স্বপদে বহাল আছেন । স্বপদে অভিযুক্তকে রেখে অধিকতর তদন্ত করতে গঠিত কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.