রায়হান আহমেদ তপাদার-ইংল্যান্ড-লেখক, গবেষক ও কলামিষ্ট ঃ ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাতের উত্তেজনা অনেকটাই থিতিয়ে এসেছিল। কিন্ত সম্প্রতি হিজবুল্লাহর মহাসচিব নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ড ঘিরে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা আবার তুঙ্গে। মূলত ইরানে ইসরায়েলের সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান যা বলেছে, তাতে সেটাই মনে হচ্ছে। তবে ইসরায়েলের এমন সংযমী আচরণের পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে মার্কিন চাপ ও দেশটির অভ্যন্তরীণ বিভাজন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে দেশটির যুদ্ধ মন্ত্রিসভা ইরানে ব্যাপক শক্তি নিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা অনুমোদন দিলেও পরে তা থেকে পিছিয়ে আসে। বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত অন্তত তিনটি ইসরায়েলি সূত্র এটি জানিয়েছে। যদিও ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইসরায়েল দ্রুত প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে, ইসরায়েলের পাল্টা জবাব কতটা ভয়াবহ হবে? ইরানি তেলের স্থাপনা কিংবা পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো লক্ষ্যবস্তু হতে পারে? নাকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত কূটনৈতিক পথে চলবে তারা, এটাই দেখার বিষয়।ইসরায়েলের এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, দেশটি দ্রুত প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং সামরিক ও গোয়েন্দা নেতারা প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেছেন। তবে আসন্ন রোশ হাশানা ও অন্যান্য ছুটির কারণে সময় নির্ধারণ জটিল হয়ে পড়েছে। তবুও, ইসরায়েল দ্রুত আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত। এই অস্থির পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এটি একের পর এক উত্তেজনা বৃদ্ধির চক্র।ইসরায়েল অবশ্য গুতেরেসকে ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা করেছে। ইরানের বিরুদ্ধে স্পষ্ট কোনও নিন্দা প্রকাশ না করায় এমন পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ইসরায়েল যদি কোনও ভুল করে, তবে তারা আরও ভয়ানক জবাব পাবে। এই পরিস্থিতি পশ্চিমা দেশগুলো এবং বিশ্লেষকদের মনে বড় আশঙ্কা তৈরি করেছে।ইরানের মদদপুষ্ট গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত সরাসরি তেহরানের সঙ্গে যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছিলেন, আগামী দিনগুলোই মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। কিন্তু বাস্তবতা তিনি বুঝতে পারেননি। এমনকি তখনও তিনি আশা করেছিলেন, হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েল উভয়ে খাদের কিনার থেকে ফিরে আসবে। কিন্তু দেখা গেল, হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। যুদ্ধের ১১ মাস পর অবশেষে তারা সেই খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে এবং এমন সংকটে পড়েছে, যা আগে দেখা যায়নি। ইরান যদি কেবল নিন্দার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তার বিশ্বাসযোগ্যতা হুমকির মুখে পড়বে। বাস্তবতা বলছে, ইরান হয়তো হিজবুল্লাহকে ক্ষয়ক্ষতি মেনে যুদ্ধবিরতির পক্ষে অবস্থান নেওয়ার পরামর্শ দিতে পারে। যদিও গাজায় যুদ্ধবিরতি আসেনি। অন্যদিকে ইরান যদি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক হামলা চালায়, সেটাও অর্থবহ হতে হবে। ইরানের জানা আছে, তারা এমন সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামছে, যার উচ্চতর প্রযুক্তিসম্পন্ন অস্ত্র আছে এবং যার গোয়েন্দা দক্ষতা অসাধারণ। এটা স্পষ্ট- ইসরায়েলের গোয়েন্দারা হিজবুল্লাহর গভীর পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং তেহরানেও এমনটি ঘটেছে। ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান যখন নির্বাচিত হলেন তখন প্রত্যাশা ছিল, পশ্চিমের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাঈদ আব্বাস আরাগচি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকের জন্য নিউইয়র্কে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন।
তাছাড়া তিনি জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক ও ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড ল্যামির মতো ইউরোপীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দেখা করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি পুনরুদ্ধার করার জন্য আলোচনা পুনরায় চালু করতে তাদের রাজি করানো।ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে পারমাণবিক এ চুক্তি বাতিল করেন। কিন্তু হাসান নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ডের পর সংস্কার পন্থিদের পক্ষে ইরানের সামরিক বাহিনীকে ওই রকম কোনো চুক্তিতে রাজি করানো অনেক কঠিন হয়ে গেল। কারণ এখন সুসম্পর্ক স্থাপনের সময় নয়। ইতোমধ্যে পেজেশকিয়ান অভিযোগ করেছেন, ইসরায়েলের হাতে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহ হত্যায় অবিলম্বে প্রতিশোধ না নেওয়ার জন্য পশ্চিমা আবেদন শুনে খুব একটা লাভ হয়নি। পেজেশকিয়ান বলেন, তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল-গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি এবং জিম্মি-ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যেই বাস্তবায়ন হবে। অথচ চুক্তিটি বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ ইরানের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে নিতে যথেষ্ট চাপ দিতে অস্বীকার করে। পেজেশকিয়ানের জন্য এটা হতাশার। হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যুর সঙ্গে যে যুক্তরাষ্ট্রের হাত নেই-এটি তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। এমনকি নেতানিয়াহু হিজবুল্লাহ নেতাকে নিউইয়র্কে থেকেই হত্যার নির্দেশ দেন; সেই বোমাও যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া, যেটি বিস্ফোরণ হয় বৈরুতে। হাসান নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ডের পরপরই বিবৃতিতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি মুসলমানদের আহ্বান জানিয়ে লেবাননের জনগণ ও গর্বিত হিজবুল্লাহর পাশে যে কোনো উপায়ে দাঁড়াতে বলেন এবং ইসরায়েলের শাসন রুখে দিতে বলেন। নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ড ওয়াশিংটনের জন্য কূটনৈতিক অবমাননা এবং মিত্র নিয়ন্ত্রণে তার অক্ষমতা বা তার প্রতি মিত্রের অবিশ্বস্ততার শামিল।
নেতানিয়াহু ভাবছেন, নিউইয়র্কে মার্কিন কূটনীতিকদের তিনি বোকা বানিয়েছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জোর দিয়ে বলেছে, ইসরায়েলের কৌশল পরিকল্পনামন্ত্রী রন ডার্মার ও নেতানিয়াহুর সঙ্গে আলোচনা করেই ঠিক হয় যে, ইসরায়েল ২১ দিনের যুদ্ধবিরতি মেনে নেবে। কিন্তু এ ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতানিয়াহু বলেন, এ প্রতিশ্রুতি তার পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব নয়। আমেরিকার প্রায় ১২ মাসের কৌশল যে ব্যর্থ, তারই প্রমাণ ধ্বংসস্তূপে রয়েছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েলকে গাজায় খাদ্য সরবরাহ, নিরাপদ অঞ্চল তৈরি, রাফাহ আক্রমণ, যুদ্ধবিরতির শর্ত এবং সর্বোপরি সংঘাত এড়াতে ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করতে বলেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাস্তবে তা মানেনি ইসরায়েল। এইভাবে প্রতিবার নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ মানার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত ওয়াশিংটনকে উপেক্ষা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে বিরক্ত ও হতাশ; তবে নেতানিয়াহুর কৌশল সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করলেও যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ বন্ধ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সন্নিকটে। এদিকে নেতানিয়াহু ইসরায়েলে অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন।অন্যদিকে কয়েকটি আরব দেশ নাসরাল্লাহর মৃত্যুতে শোক করছে। এ অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কার্যকর কোনো বিকল্প নেই বললেই চলে। নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি জিতছেন এবং পুরো জয়ের পথে রয়েছেন। ঠিক এই মুহূর্তে ইরান যদি তার পদক্ষেপের মাধ্যমে নিজেকে ইসরায়েলের চেয়ে কঠোর প্রমাণ করতে না পারে, তবে নেতানিয়াহুই বেঁচে যাবেন, যিনি এখন চালকের আসনেই আছেন। তবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া ব্যাপক হলে ইরানও বসে থাকত না। দেশটির হাতেও ব্যাপক বিকল্প আছে। দেশটির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার দাবি, ইরানের প্রতিক্রিয়া জানানোর বিকল্পগুলোর মধ্যে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়া।
যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের প্রায় এক পঞ্চমাংশ তেল বাণিজ্য সংঘটিত হয়,প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোকে ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থে আঘাত করতে লেলিয়ে দেওয়া আহ্বান জানানো এবং যেসব ক্ষেপণাস্ত্র আগের হামলায় ব্যবহার করা হয়নি, এবার সেগুলো ব্যবহার করা উল্লেখযোগ্য।সব মিলিয়ে ইসরায়েলে রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বিভেদ, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও অন্যান্য কৌশলগত কারণেই দেশটি ইরানে ব্যাপক হামলা না চালিয়ে সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত হামলা চালিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার সব উপাদান রয়েছে। ইসরায়েলের কিছু রাজনীতিবিদ এখন এটিকে সুযোগ হিসেবে দেখছেন ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প এবং তেলের অবকাঠামোতে আঘাত হানার জন্য। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট বলেছেন, আমাদের এখনই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করতে হবে।যুক্তরাষ্ট্র এই পরিস্থিতিতে কতটা সম্পৃক্ত হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।ওয়াশিংটন ইতোমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার সেনা পাঠিয়েছে এবং এর যুদ্ধজাহাজ ইসরায়েলের দিকে ছোঁড়া কিছু ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করেছে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত ও একটি সামরিক অভিযানের পাল্টা হামলায় নতুন সংঘাত তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। পারমাণবিক অস্ত্রধারী ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যে কোনও যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্বের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর ভয়ানক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সময়ই বলে দেবে পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নিচ্ছে।