সাদি মোহাম্মদ, আমেরিকা- লেখক, গবেষক ও কলামিষ্ট ঃ কোটা সংস্কার নয় দেশের মানুষের সংস্কার দরকার। আচ্ছা বাংলাদেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে কত কোটি মানুষ সরকারি চাকরি করে আর কত কোটি মানুষ বেসরকারি চাকরি করে ? কত কোটি মানুষ ব্যবসা বা নিজস্ব কাজ করে ? প্রতিবছর কতজন মানুষের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ থাকে এবং কতজন মানুষের বেসরকারি ও অন্যান্য পেশায় প্রবেশের সুযোগ থাকে ?
উপরের প্রশ্নগুলোর কেউ একজন একটু উত্তর দেবেন দয়াকরে।
তবে উত্তর পাওয়ার আগেই এটুকু বলছি যে, অন্যান্য চাকরি বা পেশার তুলনায় দেশে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা অনেক কম এবং প্রতিবছর অন্যান্য চাকরি বা পেশার থেকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ বা সংখ্যাও অনেক কম।
আর সরকারি চাকরি ব্যাতিত অন্যান্য চাকরি বা পেশাতে কোন রকম কোটা বা বিশেষ সুযোগের ব্যাবস্থা নাই এটা আমাদের সকলেরই জানা। কিন্তু সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সীমীত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমাদের ছেলে মেয়েরা যেভাবে করেই হোক না কেন একটা সরকারি চাকরি পেতে খুবই স্বচেষ্ট। এই যে যেভাবে করেই হোক একটা সরকারি চাকরি পেতে হবে বা করতে হবে এর কারণ কী কিম্বা এর পেছনে যুক্তি কী ? এই প্রশ্নের উত্তরটাও কেউ দিবেন দয়া করে।
এবার আসি একটু বিসিএস এর কথায়। বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ ছাত্ররই প্রথম এবং প্রধান স্বপ্ন হলো পড়া লেখা শেষে বিসিএস দিয়ে সরকারের একজন প্রথম শ্রেনীর সরকারি কর্মকর্তা হওয়া। শুধু প্রথম শ্রেনীর সরকারি কর্মকর্তা হওয়াই নয় প্রায় সকলেরই টার্গেট বা চয়েজ থাকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হওয়া। এই যে অন্য সব কিছু রেখে একজন প্রথম শ্রেনীর প্রশাসনিক কর্মকর্তা হতে চাওয়া এর পেছনের কারণ কি ? আমার মনে হয় আপনাদের কাছে খুব বেশি প্রশ্ন করা হয়ে যাচ্ছে আমার। সত্যি কথা বলতে কি আমার মনে আজ অনেক প্রশ্ন আপনাদের কাছে। বিরক্ত হলেও আপনারা আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিবেন দয়া করে।
বাংলাদেশে বিসিএস দিয়ে আসা একজন সচিবের বেতন সর্বসাকুল্যে এক লক্ষ টাকার কিছু বেশি। বিসিএসের মাধ্যমে সচিব হওয়া ব্যক্তিটি যদি কোন ভালো বেসরকারি বা কর্পোরেট অফিসের বড় চাকুরে বা বস হতেন তাহলে তার বেতন এর চেয়েও অনেক বেশি হতো। কিম্বা উনি যদি উনার নিজের বিদ্যা বুদ্ধি দিয়ে কোন ব্যবসা করতেন তাহলে উনার আয় একজন সচিবের বেতনের থেকে অনেক বেশি হতে পারতো। কিন্তু এদেশের ছাত্রদের বিসিএস দিয়ে একজন সরকারি বড় কর্মকর্তা হওয়াই লাগবে। আর এর কারণ অন্য কিছু নয়, একবার কোনভাবে সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারি হতে পারলে টাকায় টাকা। বৈধ অবৈধ টাকা আর ক্ষমতার কোন শেষ নাই তাতে। আর এজন্যেই সকলের একটা সরকানি চাকরি চাইই চাই। তা সে কোটার মাধ্যে হোক, ঘুষ দিয়ে হোক কিম্বা মামা চাচার সুপারিশেই হোক। বিএ এমএ পাশ করে একটা সরকারি অফিসের পিয়ন হতেও বাধে না অনেকের। এর কারণ কী তা আমাদের কারোরই অজানা নয় নিশ্চই। হালের সরকারি অফিসের পিয়ন ড্রাইভাররা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সরকারি অফিসের একজন সামান্য পিয়ন ড্রাইভার হয়ে যদি কোটি কোটি টাকা আয় করা যায় তাহলে গার্মেন্টস বা বেসরকারি অফিসে কে চাকরি করতে যাবে।
বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রসঙ্গে আসি এবার। ২০১৮ সালে যখন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে প্রথম আন্দোলন হয় তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি চাকরির সমস্ত কোটাই বাতিল করে দেন। ফলে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেমে যায়। কিন্তু এতে করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সুযোগে তৃতীয় পক্ষের অর্থাৎ জামায়াত বিএনপির ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের দূরভিসন্ধিও শুরু হতে না হতেই থেমে যায়। ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৪ জুন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু গোল বাধে জুনের ৫ তারিখে হঠাৎ করে কোটা নিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক এক অযাচিত রায়ে। এই রায়ে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করে পুনরায় সরকারি চাকরিতে পূর্বের সমস্ত কোটা পুর্নবহালের কথা বলা হয়। আর এই রায় দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশের ছাত্ররা মহামান্য রাস্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেয়া সহ সরকারি চাকরিতে কোটা পুর্নবহালের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আদেশে কোটা নিয়ে হাইকোর্টের নতুন রায় বাতিল চেয়ে সরকারের তরফ থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়। কিন্তু আন্দোলনরত ছাত্ররা তাদের আন্দোলন চলমান রেখে মিছিল মিটিং করতেই থাকে। এমতাবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে ছাত্রদেরকে ধৈর্য্যধারণ করতে বলেন। বলেন আদালত থেকে একটা ভালো রেজাল্ট আসবে নিশ্চই। উল্লেখ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ খুবই সংক্ষিপ্ত ছিল এবং উক্ত ভাষণের মাধ্যমে আন্দোলনরত ছাত্ররা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কোটা বাতিলের মতো কোন বক্তব্য না পেয়ে ভীষণ আশাহত হয়। যদিও আদালতে বিচারাধীন একটা বিষয়ে আদালতের রায় আসা না পর্যন্ত সরাসরি কোন রেজাল্ট আগে থেকেই বলে দেয়া যায় না। কারণ এটা আদালত অবমাননার শামিল। আর এজন্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরাসরি কোন বক্তব্য দেন নাই। কিন্তু আদালতের রায়ে ভালো কিছু হবে একথা স্পষ্ট করেই বলেছেন।
এদিকে ছাত্র আন্দোলন অহিংস থেকে সহিংসতায় রূপ নেয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাননীয় সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে মাঠে নামে ছাত্রলীগ। যদিও কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্রলীগও ছিল শুরুতে। কিন্তু গোল বাধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে একই দিনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা এবং ছাত্রলীগ একসঙ্গে সমাবেশের ডাক দিলে। কোটা আন্দোলনকারীদের সমাবেশ সকাল থেকে শুরু হয়ে বেলা তিনটার মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা তিনটার পড়েও রাজু ভাস্কর্য না ছেড়ে ‘তুমি কে আমি কে ? রাজাকার রাজাকার’ বলে স্লোগান দিতে শুরু করলে ছাত্রলীগের কর্মীরা কোটা আন্দোলনকারীদের উপর চড়াও হয়। এতে করে দুই পক্ষের মধ্যে বেধে যায় সংঘর্ষ। কোটা সংস্কার আন্দোলন বাক নেয় অন্যদিকে। একে একে সারা বাংলাদেশর প্রায় প্রত্যেকটা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কোটা সংস্কারের দাবীতে রাস্তায় নেমে আসে। এবার বেধে যায় আইন সৃংঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মুখো মুখো সংঘর্ষ। অনেকে আহত হওয়াসহ মারা যায় আন্দোলরত বেশ কিছু ছাত্র। যারমধ্যে রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিরস্ত্র আবু সাঈদের মর্মান্তিক মৃত্যু অনেকের মনকেই ভীষণ ভাবে নারা দেয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন এতটাই সহিংসতায় রূপ নেয় যে তা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে পড়ে তৃতীয় পক্ষ জামায়াত বিএনপি। সারা দেশে শুরু হয় ভাঙচুর জ্বালাও পোড়াও। নষ্ট হয় দেশের মূল্যবান জাতীয় সম্পদ। অপ্রত্যাশিত ভাবে একে একে নিহত হয় প্রায় বেশ কিছু আন্দোলনরত ছাত্র। নিহত হয় পুলিশসহ সাধারণ জনগণও। আহত হয় আরও অনেকেই।
১৯৭১ সালে দেশ স্বধীন হওয়ার পর কোন আন্দোলনে সারা দেশ ব্যাপী কোন কিছু নিয়ে এতটা সহিংস আন্দোলন হয় নি কখনোই। এতএত মানুষও মারা যায় নি। নষ্ট বা ক্ষতির সম্মুখিন হয় নি দেশের জাতীয় সম্পদ।
কিন্তু ছাত্রদের এই আন্দোলন এত দূর পর্যন্ত যাওয়ার কথা ছিল না। এখানে তৃতীয় পক্ষের চক্রান্ত ছিল। সরকারের সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়াতেও ভুল ছিল। ভুল ছিল আন্দোলনরত ছাত্রদেরও। কিন্তু সকল পক্ষের ভুল আর তৃতীয় পক্ষের সুযোগ নেয়ায় অনেকগুলো মানুষের জীবন অকালেই ঝরে গেছে ইতোমধ্যে। দেশের অবকাঠামো ও অর্থনীতির অপুরনীয় ক্ষতি হয়েছে।
আমার লেখার শেষের দিকে এসে আমার আবারও পশ্ন কোটা সংস্কার সমস্যা কি বর্তমান বাংলাদেশের প্রথম ও প্রধান সমস্যা ? সরকারি চাকরিতে যদি কোটা নিয়ে কোন সমস্যা না থাকতো তাহলে ঠিক এরকম সময়ে এসে দেশের অন্য কোন সমস্যা নিয়ে আজকের ছাত্ররা কি আন্দোলন করতো ? আমার এই প্রশ্ন দুটিরও উত্তর দিয়েন দয়া করে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের শেষের দিকে এসে আন্দোলনরত ছাত্ররা দাবী তুলেছেঃ ‘আমরা দেশেরও সংস্কার চাই।’ আমার কাছে এই সংস্কারটাই সবচেয়ে বড় মনে হয়েছে। যার মধ্যে কোটা সংস্কারসহ আরও অনেক সংস্কার রয়েছে। ছাত্ররা কি আলাদা করে কোটা সংস্কার আন্দোলন না করে দেশ সংস্কারের আন্দোলন করতে পারতো না ? কিম্বা এখনো করতে পারে না ? আমার ধারণা দেশ সংস্কারের আন্দোলন ছাত্ররা করবে না। কারণ দেশ সংস্কার মানে সরকারি চাকরিতে কোন ঘুষ বা দুর্নীতি না থাকা। কিন্তু আজকের আন্দোলনরত ছাত্ররা তো একটা সরকারি চাকরি পেতে চায়। কারণ সেখানে ঘুষ দুর্নীতির সুব্যাবস্থা আছে। আর অপ্রিয় হলেও সত্য যে আজকের আন্দোলনরত ছাত্রদের বাবা মা থেকে শুরু করে অনেকেই সরকারি চাকরি করেন। যারা কিনা ঘুষ দুর্নীতি বা অবৈধ আয়ের সঙ্গে কোন না কোন ভাবে সম্পৃক্ত।
আন্দোলনরত ছাত্ররা জানে না যে কোন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোন কোটাতেই আজ আর চাকরি হয় না কারও। সরকারি চাকরি হয় ঘুষের মাধ্যমে কিম্বা মামা খালু ও মন্ত্রী এমপির সুপারিশের মাধ্যমে। বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে এটাই হলো সবচেয়ে বড় কোটা। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের আন্দোলন করতে গিয়ে এই যে ‘আমি কে তুমি কে ? রাজাকার রাজাকার’ বলে রাজাকার হওয়া। জীবন দেয়া। দেশের সম্পদের ক্ষতি করা। এসব করে লাভ কী হলো তাহলে ? আবারও আমার প্রশ্ন আপনাদের কাছে।
আসলে কোটা সংস্কার নয় দেশ সংস্কারের আন্দোলন হওয়া উচিত ছিল। জীবন যদি দিতেই হতো দেশ সংস্কারের জন্য দেয়া উচিত ছিল। তাহলে শুধু সরকারি চাকরির কোটাই নয় পুরো দেশটাই বদলে যেত। দেশ থেকে বিতারিত হত দুর্বৃত্ত ও দুর্বৃত্তায়ন। সকল অরাজকতাসহ বন্ধ হত ঘুষ দুর্নীতি। বিনির্মান হত রাষ্ট্র। জন্ম হত আরেকটি নতুন বাংলাদেশের।
অতএব সংস্কার যদি হতেই হয় শুধু কোটা সংস্কার নয় সংস্কার হওয়া উচিত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সমগ্র বাংলাদেশের।