বাংলাদেশের নিরাপত্তারি আত্নিক দর্শন এবং ২০২৩ সালের প্রত্যাশা

লেখকব্রি: জে: মোঃ নাসিমুল গনি, পিএইচডি, এমডব্লিউএস, এমডিএস, এএফডব্লিউ, পিএসসি (অব:):

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ম্যাগাজিন ”সেনাবার্তা জুলাই ২০১১” আমার প্রকাশিত ”আমাদের স্বপ্নের স্বশস্ত্র বাহিনীর কথা ও প্রত্যাশা লেখাটির পর সুদীর্ঘকাল পেরিয়ে গিয়েছে । বৈশি^ক রাজনীতি, সামরিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশলের বৈপ্লবিক পরিবর্তন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, আফগানিস্থান হতে যৌথ বাহিনীর প্রত্যাহার, বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নয়ন, নদীবহুল বাংলাদেশের ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তন, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তির ২৫ বৎসর অতিক্রম হওয়া, রোহিঙ্গাঁ জনগৌষ্টির দীর্ঘকালীন শরনার্থী জীবনের ধারাবাহিকতা, প্রতিবেশী ভারতের ভূরাজনৈতিক ভূমিকা, গোল্ডেন ট্রাংগেলের মাদক ও অস্ত্র ব্যবস্যার উন্মুক্ত প্রভাব, জাতীয় অর্থনীতি ও রাজনীতিতে কোভিড ১৯ ও অন্যান্য নিয়ামকের অস্থির ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার কারনে নরম শক্তির

(Soft Power) অভাবনীয় নিরাপত্তা প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব, বিশ^ব্যাপী মুদ্রা, ডাটা ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিবিধ সামরিক, বানিজ্যিক ও অর্থনৈতিক জোট/সংস্থার সৃষ্টি ইত্যাদি কারনে বাংলাদেশে হাইব্রিড যুদ্ধ ((Hybrid Warfae) বিশেষ ও শংকামূলক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে । ২০১২-২০১৬ পর্যন্ত কুয়েত, কাতার, বাহরাইনে বাংরাদেশ দূতাবাসে প্রতিরক্ষা এ্যাটাচী হিসাবে দায়িত্ব পালন এবং অবসর পরবর্তীতে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত গবেষনা আমার মনো:জগতে বিপুল প্রভাব এনেছে । তাই আমি পূর্বের লেখাকে পুন:মার্জিত করে জাতীয় স্বার্থে সবার নিকট উপস্থাপিত করতে চাই । দেশের নিরাপত্তার দর্শন নিয়ে বিগত দিনগুলোতে সীমিত পর্যায়ে কয়েকটি প্রকাশনা, ধারনা ও তত্ব কয়েকজন শ্রদ্ধাবান সামরিক ও অসামরিক ব্যাক্তিত্ব ইতিমধ্যে তুলে ধরেছেন । এরসাথে আছে আমাদের সরকারের অনুসৃত প্রতিরক্ষা নীতিমালা । দেশে ও বিদেশে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ভাবনার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে । এখন অপ্রচলিত নিরাপত্তা শংকাকে (Non Traditional Threat ) অধিকতর গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতঃ হাইব্রিড যুদ্ধ অবস্থাকে সামনে আনা হয়েছে । ফলে প্রচলিত যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য সুবিধাদি অপ্রচলিত নিরাপত্তা বিষয় হতে প্রাপ্তির চেষ্টা চলছে ।

ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র ও জনবহুল দেশ তার নিরাপত্তা নিয়ে একটি অস্বস্তিকর এবং অধিকতর ঝুঁকিপূর্ন অবস্থায় পৌছে গিয়েছে । এই পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থা ও প্রকৃতি নিয়ে চিন্তাবিদদের ভিতরে আপাততঃ মতপার্থক্য রয়েছে । কিšদ নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টির ব্যাপারে সবাই একমত ও সবাই চিন্তিত ও অস্থির অবস্থায় রয়েছে । দেশের আপাময় জনগন, সমরবিদ, বুদ্ধিজীবী, আমলাতন্ত্র এবং রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকরা তাই বর্তমান নিরাপত্তার বিষয়টির গুরুত্ব ও বাস্তবতা অনুভব করবেন বলে আশা করা যায় ।

সামরিক ইতিহাসকে আমরা খুব বেশী চর্চা করিনা বিধায় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ধারাবাহিকভাবে জনগনকে সম্পৃক্ত করার প্রবনতা ও ইচ্ছা কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিত কখনই দেখা যায় নি । একটি শিশুকে গড়ে তোলার মূল দায়িত্বে থাকেন মা, ঠিক তেমনি একটি দেশের ”নিরাপত্তার আতিœক দর্শন (Core Philosophy of Security)” সুচিন্তিত ও সার্বিকভাবে বিবেচনা করা হলে তা দিকনির্দেশ করবে কিভাবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সমুন্নত রাখা যাবে । জাতীয় স্বার্থ ও আদর্শকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করলে যে কোন দেশ তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নিশ্চিত করতে পারে । সুইজারল্যান্ড, আফগানিস্থান, ইজরাইল, তাইওয়ান, সিঙ্গাঁপুর, উত্তর ও দক্ষিন কোরিয়া, জাপান, কিউবা, ভেনিজুয়েলা , মেক্রিকো, লেবানন, ইরান, মায়ানমার, জার্মানী, কুয়েত, কাতার , লিবিয়া, গ্রীস, সার্বিয়া, কসোভো, সুদান, সোমালিয়া, বতসোয়ানা ইত্যাদি দেশসমূহ তাদের নিজস্ব চিন্তা, ধ্যান ধারনা, আঞ্চলিক পরিবেশ, সক্ষমতা, ভূপ্রকৃতি ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে সার্বভৌমত্বকে রক্ষার দর্শন ও কৌশল চিহ্নিত করেছে । এইসব দেশ সমূহ কিভাবে তাদের স্বন্ত্রতা বজায় রেখেছে তা বহুলভাবে গবেষনা করার প্রয়োজন । বাংলাদেশ বিশ^ সামরিক ইতিহাসের একটি অনন্য উদাহরন । পূর্বপরিকল্পনা ব্যাতিত ও অপ্র¯দত অবস্থায় (ভিন্নমত রয়েছে) নয় মাসের জনযুদ্ধে বিভিন্ন মত, আদর্শ, শক্তিমত্তা, ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি বিষয়াদি সত্বেও জাতীয় ঐক্যে এবং বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বার অবলুপ্তি সম্ভাবনায় ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর বাঙ্গালী জাতি (সকল ক্ষুদ্র নৃতাত্বিক জাতিগৌষ্টিসহ) বাংলাদেশ নামক দেশের জন্ম দিয়েছে । দীর্ঘ ৫০ বৎসর পর বাস্তবিকতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা অরক্ষিত হবার বিষয়টি আলোচনা ও বিবেচনার বিষয়ব¯দ হয়েছে । সম্ভবত এই আলোচনাটি এখনও আঁতুড় ঘরে ও সীমিত পর্যায়ে যা সাধারন ও বৃহত্তর জনগৌষ্টির নিকট যথাযথ ভাবে আমরা পৌঁছাতে পারিনি । নীতি ও নৈতিকভাবে এটি স্বীকৃত যে, দেশের প্রতিটি নাগরিকের আশা আকাঙ্খা ও সক্ষমতাকে সম্পৃক্ত করেই দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে নিশ্চিত ও রক্ষা করতে হয় । বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নীতিমালা, সশস্ত্র বাহিনীর মান উন্নয়নের জন্য ফোর্সেস লক্ষ্য-২০৩০, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রযুক্তিগত গবেষনা ও প্রয়োজনীয়তা এবং বর্তমান পরনির্ভরশীলতা ইত্যাদি পুন:মূল্যায়নের অত্যাবশ্যিকতা আজ সর্বপর্যায়ে অনুভূত হচ্ছে । আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাংলাদেশের নিরাপত্তা দর্শনে মুক্তিযুদ্ধের আদলে জাতীয় ঐক্য, ভূপ্রকৃতি ও স্থানীয় প্রযুক্তির উপর স্বনির্ভরতা, বহুমাত্রিক উৎপাদন শীলতা, অতি ক্ষুদ্রস্থায়ী ও একত্রীভূত ((Integrated) স্বশস্ত্রবাহিনী, জনগনের সার্বক্ষনিক

অংশীদারিত্ব ও অংশগ্রহন, নরম শক্তির (Soft Power) মাধ্যমে কঠিন শক্তির (Hard Power) রসদের যোগান এবং হাইব্রিড যুদ্ধের কলাকৌশল, চিহ্নিত করন, সীমিত করার ব্যবস্থা গ্রহন ইত্যাদি যথাযত ভাবে বিবেচনা করে এই দেশের জাতীয় নিরাপত্তার দর্শন প্রনীত হতে পারে । এই সশস্ত্র ও নিরাপত্তা বাহিনী হতে হবে ভূপ্রকৃতিভিত্তিক সংগঠিত, অস্ত্র , সরঞ্জামাদি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রশাসনিকভাবে স্বনির্ভর এবং বহুমুখী পেশায় দক্ষ সাধারন জনগৌষ্টির উপর নির্ভরশীল । সংবিধান ও জনগনের প্রতি আদর্শিক আনুগত্য এবং সার্বজনীন নিরাপত্তা ধারনা, প্রশিক্ষন ও বৃহত্তর রিজার্ভ সৃষ্টির মাধ্যমে সকল পেশা, কর্মবন্টন, উৎপাদনশীলতাকে বৃহত্তর নিরাপত্তার (প্রচলিত ও অপ্রচলিত নিরাপত্তা) সাথে সুদৃঢ় বাঁধনে আবদ্ধ ও স্থিতিস্থাপক সক্তি হিসাবে চিহ্নিত করা যায় তবে তা হবে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও উন্নয়নের আদর্শিক দর্শন ও ভিত্তি । একথা স্মরন যোগ্য যে, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন (Security & Developmen) সকল সময় একে অপরের পরিপূরক । বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে । স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বিভিন্ন চড়াই উৎড়ায় পার হয়ে একটি প্রশিক্ষিত বাহিনী হিসেবে দেশ ও বিদেশে তার নিজস্ব অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে । দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক এই বাহিনীকে রুপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ এবং ফোর্সের লক্ষ্য ((Forces Goal) ২০৩০ এর সাথে তাল মিলিয়ে এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, অবকাঠামো, কার্যপদ্ধতি ও জনগণের সাথে সম্পৃক্ততার একটি মডেল উপস্থাপন করা যায় । সার্বভৌমত্বের রক্ষক সশস্ত্র বাহিনী । বাংলাদেশের সংবিধান, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, সরকার প্রধান, বিভিন্ন প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবি,  পেশাজীবিসহ সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, চলমান বিশে^র ভূরাজনৈতিক গতি প্রকৃতি, বিশ^ায়ন এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজের নবজাগরণ বিশ্লেষণপূর্বক বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা ও দায়িত্বমূল্যয়ন করা যায় । একটি সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনার মাধ্যমে বাহিনীত্রয়ের কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ, অপারেশন এবং দেশজ উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনায় অংশগ্রহণের রুপরেখা প্রনয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে একে জাতীয় সশস্ত্র বাহিনীতে উত্তরণ ঘটানো যায় । দেশের নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ঠ অন্যান্য বাহিনীসমূহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সকল সময় একটি দৃঢ় চেইন অফ কমান্ডের আওতাধীনে থাকবে । এই বাহিনীর প্রত্যাশিত ভূমিকার জন্য প্রস্তাবিত রুপরেখার ধারণা নি¤েœ উপস্থাপন করা হলো ঃ

ক । মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ দ্বারা লালিত হয়ে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থ রক্ষার জন্য নিজের সর্বোচ্চ পেশাদারীত্ব ও জাতীয়
প্রতিরক্ষা কৌশলের সাথে সামঞ্ছস্য রেখে আধুনিক কলাকৌশল ও দেশজ সম্পদের সমন্বয় ঘটিয়ে সশস্ত্র বাহিনী ও অপারপর
নিরাপত্তা বাহিনীর উন্নয়ন ঘটানো হবে ।

খ । এই বাহিনীর সদস্যরা আতিœক, মানসিক, শারীরিক ও কলাকৌশলগত দক্ষতার দ্বারা জাতীয় আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং রুপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ এর স্ট্রাটেজিক অংশীদারীত্বে অংশ নিয়ে দেশকে উন্নত, দক্ষ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত কল্যাণকর রাষ্ট্রের মর্যাদায় উন্নীত করার লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরে এবং বৈদেশিক পরিমন্ডলে যথোপযুক্ত ভূমিকা পালন করবে ।

গ । আধুনিক প্রািশক্ষণপ্রাপ্ত, সুশৃঙ্খল এবং সর্বোচ্চ দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ছোট ও দক্ষ সশস্ত্র বাহিনী জনগণ ও মানবাধিকার সমর্থনপুষ্ট হবে যারা সংবিধানের মূলনীতি ও আদর্শকে সমুন্নত রাখার মাধ্যমে ন্যায়বিচার, আইনের শাসনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার
দিবে ।

ঘ । সশস্ত্র বাহিনীর কার্যক্রমের মধ্যে স্বচ্ছতা, দৃঢ়তা এবং লক্ষ্য অর্জনের বলিষ্ঠতা থাকতে হবে যার মাধ্যমে এ সংগঠন যুগোপযোগী, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারপূর্বক সকল ক্ষেত্রে গতিময়তা, স্বচ্ছতা, প্রজ্ঞা, চাতুর্য্য এবং নেতৃত্বের গুণাবলীর সমন্বয় ঘটাবে ।

ঙ । সশস্ত্র বাহিনী সকল শ্রেনী ও পেশার জনগণের অংশগ্রহণ দ্বারা সামগ্রিক শক্তির স্ফূরণের মাধ্যমে দেশ হতে অনৈতিকতা ও অপরাপর অসামরিক নিরাপত্তা শংকাকে দূর করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত উন্মোচন এবং জনগণের ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও ¯েœহ অর্জন করবে ।

চ । স্বশস্ত্র বাহিনীকে সকল সময় সৎ ও ন্যায়ের পথে রেখে জনগণের বাহিনীতে পরিণত করার তাগিদে উপযুক্ত নেতৃত্ব, গুনাবলী, শৃঙ্খলাবান, আদর্শ এবং মানবিক ও জ্ঞান জগতের সাথে সম্পৃক্ত নেতা ও মানুষতৈরি করবে যারা নিজেদের দেশের সেবক হিসেবে সর্বোচ্চ আতœত্যাগের মাধ্যমে দেশ ও জনগণের জন্য জীবন উৎসর্গ করতেপারে ।

ছ । সশস্ত্র বাহিনী সাংগঠনিকভাবে উৎপাদনমুখী হয়ে নিজস্ব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য, সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে আর্থিক স্বয়ংসম্পূর্নতা অর্জনের সকল পদক্ষেপ নিবে । নিজেদের অপারেশনাল দক্ষতা ও মান বজায় রেখে দেশের জাতীয় উৎপাদনশীলতায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করবে ।

জ । সশস্ত্র বাহিনী সকল স্তরের সৈনিকদের কল্যানোর জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য, সহযোগিতাসহ সকল প্রচেষ্টা গ্রহন করবে যেন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ^াসী সদস্যরা দেশ ও জাতির জন্য বিনা দ্বিধায় ও অকাতরে তাদের জীবন ও যৌবন উৎসর্গ করতে পারেন ।

ঝ । সশস্ত্র বাহিনী সকল সময়ে সর্বোচ্চ অপারেশনাল প্র¯দতির জন্য কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে এবং সুনির্দিষ্ট সময় ও লক্ষ্যব¯দতে  অপারেশন পরিচালনায় সক্ষম হবে । এজন্য শান্তিকালীন বিবিধ আধাসামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সম্পৃক্ত করে দেশীয় প্রযুক্তি ও স্বল্প সম্পদকে কাজে লাগিয়ে এবং জনগণের শক্তি ও জ্ঞানকে স্বাচ্ছন্দে ব্যবহার করার মানসিকতা সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করা
হবে ।

ঞ । জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশে ও বিদেশে যে প্রভাব পড়বে, সশস্ত্র বাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী তার সাথে খাপ
খেয়ে সকল প্রতিযোগিতামূলক কলাকৌশলে স্ট্রাটেজিক অংশীদারিত্ব গ্রহণের মাধ্যমে দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য সবিশেষ
চেষ্টা করবে ।

ট । সশস্ত্র বাহিনী নিজস্ব ব্যবস্থাপনা, সংগঠন এবং নেতৃত্বের দিক নির্দেশনামূলক পরিবর্তন আনায়নের মাধ্যমে ফলাফল অর্জনকারী অপারেশন (Effect based operation) এবং প্রথাগত (Traditional) ও অপ্রথাগত ((Non Traditiona) যুদ্ধকৌশলকে একত্রীভূত করবে ।

ঠ । সামরিক ও অসামরিক নিরাপত্তা শংকাকে ((Threat) চিহ্নিত করে অভ্যন্তরীন যৌথ প্রশিক্ষন ও অপারেশনের পরিবেশ সৃষ্টি
করবে ।

ড । সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদেরকে জাতীয় সম্পদ ((National asset) হিসেবে গ্রহণ এবং শান্তিকালীন সময়ে একত্রীভূত ও অংশীদারীত্ব প্রদানের মাধ্যমে এ দেশে অসামরিক-সামরিক সম্পর্কের ধারণায় নতুন দর্শন সৃষ্টি হবে যা জাতীয় উন্নয়নের মাপকাঠিতে পুঞ্জীভূত ((Synergic) প্রভাব ফেলবে ।

ঢ । জাতীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি, ইতিহাস ও সংস্কৃতির ঐক্যতানে সশস্ত্র বাহিনী লালিত হবে । এক্ষেত্রে বিদেশী জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার সবিশেষ সমন্বয় ঘটাতে হবে । সশস্ত্র বাহিনী রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত ও জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা ও সামগ্রিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ বাহিনীকে জাতীয় সশস্ত্র বাহিনীতে রুপান্তরিত করবে । জাতীয় সশস্ত্র বাহিনীর স্বপ্ন ও কার্যক্রমকে বাস্তবায়নের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় আইন ও অধ্যাদেশ পরিবর্তন, সংযোজন, বিযোজন করার প্রয়োজন হবে । এ জন্য সময় ও উদ্দেশ্যভিত্তিক সরকারি সামগ্রিক পরিকল্পনা, কার্য সম্পাদন ও নিয়ন্ত্রনের পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারকে বিভিন্ন স্তরে জোরালো, বাস্তবমুখী এবং সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণের সকল প্রকার পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন হবে ।

ণ । প্রতিটি নাগরিককে প্রথাগত ও অপ্রথাগত নিরাপত্তা ধারনার সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমে সার্বজনীন সামরিক ও নিরাপত্তা প্রশিক্ষন দিতে হবে । জাতীয় পরিকল্পনার অংশ হিসাবে পেশা ভিত্তিক ও অংশীদারীত্বমূলক সংরক্ষিত বাহিনী ও সিভিল ডিফেন্স ফোর্স তৈরী করে জাতীয় নিরাপত্তা সুদৃঢ় করা হবে ।

ত । দেশের আধাসামরিক বাহিনী, আনসার ও ভিডিপি, পুলিশ (রবী সহ বিবিধ শ্রেনী বিন্যাস) ও সিভিল ডিফেন্স বাহিনীকে জাতীয়
নিরাপত্তার সাথে আতœীকরনের প্রয়োজনীয়তা আছে বিধায় তাদের অতি পূরনো প্রচলিত আইন, নীতি মালা, অস্ত্র, প্রযুক্তির প্রাধিকার ও নিয়োন্ত্রন এবং ব্যবহারিক প্রয়োগ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ন ও বাস্তব মুখী পরিবর্তন আনায়ন করে জাতীয় নিরাপত্তা দর্শনের
সাথে সম্পৃক্ত ও সমন্বয় করতে হবে ।

থ । বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ সমন্বিতভাবে কার্যবিধির আওতাধীনে থেকে এ প্রস্তাবিত রুপরেখার কর্মপরিকল্পনা নিশ্চিত করবে । এজন্য বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে সর্বোচ্চ প্রধান্য প্রদান,
সমন্বয় ও গতিশীলতার মাধ্যমে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিশ্চিতকরার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে । এখানে উল্লেখ্য যে,

প্রত্যাশিত ভূমিকার প্রস্তাবিত রুপরেখাটি মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদনপ্রাপ্ত ও আলোচনা সাপেক্ষে জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত হওয়া
বাঞ্ছনীয় ।
সারা বিশে^ নিরাপত্তা সংক্রান্ত ধ্যানধারণায় যে পরিবর্তন এসেছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে একবিংশ শতাব্ধীর সশস্ত্র
বাহিনীর দায়িত্বও কর্তব্য এবং সংগঠনের প্রকৃতির আশু পরিবর্তন প্রয়োজন । বাংলাদেশের নিজস্বতা ও বাস্তবতা উপলব্ধিপূর্বক
সর্বপর্যায়ে প্রচলিত ধ্যানধারণা এবং মানসিকতার বিশেষ পরিবর্তন অত্যাবশ্যক । আশা করা যায় যে, প্রস্তাবিত রুপরেখার আদলে
এই বাহিনী সংগঠিত করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অধিকতর যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা
প্রদর্শন করার সক্ষমতা অর্জন করবে । নিরাপত্তার ধারনার ব্যাপকতার সাথে সামঞ্ছস্য রেখে আমাদের দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ও
সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষন ব্যবস্থাকে নতুনভাবে মূল্যায়নকরত: সকল নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত ও অংশীদারীত্ব প্রদানের গুরুদায়িত্ব
সকল স্তরের নীতিনির্ধারক ও কর্মবিভাগকে সুচিন্তিত ও বাস্তবতার নীরিখে গ্রহন করতে হবে । জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়টি
ছেলেখেলা নয় বিধায় প্রতিটি নাগরিকের উচিৎ যথাযথ ভূমিকা পালন করা । মিডিয়া, কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এবং
শিক্ষকবৃন্দ বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা দর্শনকে পরিশীলিত ও চলমান রাখার ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা এবং কান্ডারি
হিসাবে নিজেদের অবস্থানকে সূদৃঢ় করতে পারে । অন্যান্য পেশাজীবি এবং সরকারের বিভিন্ন অঙ্গসমূহ এবং রাজনৈতিক
দলসমূহ সুচিন্তিত মতামত এবং সুনিদ্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে দেশের নিরাপত্তা ব্যাবস্থাপনাকে সুনিদ্দিষ্ট লক্ষবিন্দুতে
নিয়েযাবে বলে আশা করা যায় । দেশের জনগন প্রকৃত পক্ষে তাদের সামগ্রিক দেশপ্রেম এবং প্রতিরোধ, আক্রমনাত্বক ¯ৃúহা
প্রদর্শন করে অতি চড়া মূল্যে পাওয়া আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুনিশ্চিত ভাবে রক্ষা করবে বলে আমার
বিশ^াস রয়েছে । জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ বা অনুরুপ সংগঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সার্বক্ষনিক পর্যবেক্ষন, গতিপ্রকৃতি
নির্ধারন ও কর্ম পরিকল্পনার নির্দেশনার মাধ্যমে একটি সমন্বিত নিরাপত্তা দর্শন ও ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে । সুতরাং
বাংলাদেশের নিরাপত্তার আতিœক দর্শন নিশ্চিত করে সারাবিশে^ বাংলাদেশকে শান্তি ও নিরাপত্তার মডেল হিসাবে তুলে ধরার জন্য
আমাদেরকে ঐক্যতার সাথে হাতে হাত এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিশ^ পরিমন্ডলে কাজ করতে হবে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.