বীর মুক্তিযাদ্ধা জাফর উদ্দীনের স্মৃতিচারন বঙ্গবন্ধু’র মৃত্যুর পর

কালের সংবাদ ডেস্কঃ  মুক্তিকামী যোদ্ধারা নৌকার ওপরে বসা। হঠাৎ গুলির শব্দের সঙ্গে ভেসে এলো মানুষের আত্মচিৎকার। তখনো আবছা অন্ধকার।

নিজস্ব সাইরেন বাজিয়ে যোদ্ধাদের ক্যাম্পে জড়ো হওয়ার সংকেত অধিনায়কের। তার ডাকেই শীতের রাত ভেঙে নৌকার প্লাটুনগুলো ক্যাম্পে ফিরেছে।

১৯৭১ সালে ১১ নভেম্বর সকাল। অধিনায়ক লতিফ মির্জার নির্দেশ পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লড়তে হবে। নৌকায় রাখা গোলাবারুদ অস্ত্র-সস্ত্র নামিয়ে বাঙ্কারে ঢোকানোর কাজ শুরু হলো। শুরু হলো সম্মুখ লড়াই। দুপুর পর্যন্ত চলা সেই যুদ্ধে পাক হানাদারদের পরাস্ত করে নওগাঁ স্বাধীন হলো।

শনিবার ১১ নভেম্বর ঐতিহাসিক নওগাঁ মুক্ত দিবস। সেদিনের সেই যুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছিলেন সম্মুখ যোদ্ধা জাফর উদ্দিন (৯২)। বীর মুক্তিযোদ্ধা জাফর উদ্দিনের বাড়ি গুরুদাসপুর উপজেলার চলনালী গ্রামে।

এই বীর যোদ্ধা স্মৃতিচারণ করে জানালেন, নওগাঁ ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনস্ত একটি ক্যাম্প। সম্মুখ যুদ্ধ শুরুর আগে যোদ্ধাদের ডেকে অধিনায়ক লতিফ মির্জা বলেছিলেন, শত্রুপক্ষ আক্রমণ করেছে। তাদের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। নওগাঁ স্বাধীনের জন্য তোমাদের লড়তে হবে। সবাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও। আজ নওগাঁও স্বাধীন হবে নয়তো নওগাঁর মাটিতে তোমাদের কবর হবে। সেদিন নওগাঁ স্বাধীন হয়েছে। বর্তমান নওগাঁয়ে যোদ্ধাদের নাম খচিত মিনারও তৈরি করা হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর থেকে এই দিনটিকে তারা প্রতিবছরই উদযাপন করে আসছেন।

তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর রাতে আমরা নওগাঁর পোর্তাব নামের একটি হাটখোলাতে অবস্থান করছিলাম। খবর পেলাম রাতেই নওগাঁর ক্যাম্পে ফিরতে হবে। কনকনে ঠান্ডা বাতাসে সবাই জড়োসড় হয়ে যাচ্ছিল। আমার নৌকায় ১৮ থেকে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমি ছিলাম মাঝি। সব প্রতিকূলতা ছাপিয়ে নৌকা নিয়ে চলে গেলাম নওগাঁ ক্যাম্পে। ফজরের নামাজ পড়ে সবে মাত্র নৌকার ওপর বসলাম। হঠাৎ গুলির আওয়াজ। মোট ৪০৮ জন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে জড়ো হলেন। লতিফ মির্জার নির্দেশে আমি নৌকা থেকে অস্ত্র নামিয়ে বাঙ্কারে ঢোকালাম। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।

যুদ্ধের সময় আমি বাঙ্কারে যোদ্ধাদের গোলাবারুদ এগিয়ে দিচ্ছিলাম। সেই সকাল ৭টায় যুদ্ধ শুরু হয়ে দুপুর ১টায় শেষ হলো। যুদ্ধে ৪০ জন মিলিটারির মধ্যে ১ জন জীবিত ছিলেন। সেই পাকসেনাকে সিতলাই দিঘীতে মারা হলো। আমরা যুদ্ধে জয়লাভ করলাম। নওগাঁও স্বাধীন হলো।

এরপর লতিফ মির্জার নির্দেশে নওগাঁও ক্যাম্প ভেঙে দেওয়া হলো। শত্রুপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো অস্ত্র মজুদ না থাকায় যোদ্ধাদের প্লাটুনে ভাগ হয়ে যুদ্ধের জন্য অন্যত্র যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন লতিফ মির্জা। অন্য ক্যাম্পে যাওয়ার পথে দুর্ভাগ্যবশত রাজাকারের হাতে ধরা খেলাম। হাঁসমারির সামসেল, ইদু রাজাকারসহ তার সঙ্গীরা আমাকে নিয়ে গেল লবিন নামের একটি বিলের মধ্যে নিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে গুরুদাসপুর থানায় আটকে রাখা হলো। সে যাত্রায় কোনো মতে মুক্তি পেলাম।

জাফর উদ্দিন বলেন, ‘তখনো দেশ স্বাধীন হয়নি। কিন্তু তোফাজ্জল ভাইদের সন্ধান পাচ্ছিলাম না। গোপনে খুঁজতে শুরু করলাম। এরই মধ্যে দেশ স্বাধীনের সুসংবাদটি পেলাম। শুনলাম মুক্তিযোদ্ধারা গুরুদাসপুর থানা দখলে নিবে। সাহস করে এগিয়ে এলাম। দেখলাম মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল ভাই, আব্দুস সাত্তাররা ফিরে এসেছেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থানা দখল করলাম।’

যে কারণে জাফর উদ্দিন যুদ্ধে গেলেন: ১৯৬৯ সালের আগে গুরুদাসপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শেখ মুজিবুর রহমান এসেছিলেন। তিনি নৌকায় ভোট চেয়ে প্রতিশ্রুতি দিলেন; নৌকা জয়যুক্ত হতে পারলে, কৃষক ভাইদের ২৫ বিঘা জমির খাজনা মাওকুফ করে দেবে, আর তোমাদের নামে সার্টিফিকেট মামলা হবে না। গরিব-দুখীদের জন্য বাসস্থান করে দেব। আর জেলে ভাইদের মাছ ধরার ব্যবস্থা করে দেব, তাদের জমি দেব, তাঁতি ভাইদের জন্য তাঁত করে দেব। পশ্চিম পাকিস্তানে ১৬০টি কাপড়ের মিল রয়েছে।

বাংলাদেশে একটিও নেই। আমি মিল করে দেব। যাতে আমার শ্রমিক ভাইরা খেটে খেতে পারেন। তিনি আরও বলেছিলেন চার আনা সের চিনি খাওয়াব। বাংলাদেশের মানুষকে আমি ভাতে মরতে দেব না। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে জাফর উদ্দিনরা আপ্লুত হয়েছিলেন।

জাফর উদ্দিন বলেন, ‘সে সময় গ্রামে ফিরে ১০ পয়সা দিয়ে টিকিট কিনে আওয়ামী লীগের সদস্য হলাম। গ্রামে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করলাম। আমরা নৌকায় ভোট দিলাম। বঙ্গবন্ধু জয়ী হলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কাছে গদি ছাড়া হয়নি। তারপর থেকেই আমাদের সেই কমিটি একটি সংগ্রাম কমিটিতে পরিণত হলো। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা যুদ্ধের জন্য পুরো প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম। ২৬ মার্চের পর হঠাৎ একদিন শুনতে পেলাম নাটোরের ওয়ালিয়া নামকস্থানে পাকিস্তানি মিলিটারি আক্রমণ করেছে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক লাঠি, ফলা, হাসুয়াসহ যা ছিল তাই নিয়ে আমরা ওয়ালিয়াতে গেলাম। সে সময় ওই অভিযানে ছিলেন ছাইমউদ্দিন, আব্দুল কাদের, বাচ্চু সেকেন্দারসহ অনেকই (তার কাছে রাইফেল ছিল) ছিলাম। ওয়ালিয়াতে গিয়ে দেখলাম ট্রাকের ওপর ত্রিপল দিয়ে কয়েকজনের লাশ ঢেকে রাখা হয়েছে। আজাহার মাস্টারকে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তার লাশটি ঝুলন্তই আছে। সেখানে তিন দিন থাকার পর ফিরে আসলাম। তখন চারিদিকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কেবল গুরুদাসপুরে কোনো যুদ্ধ নেই। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। নওগাঁও ক্যাম্পের সন্ধান পেলাম। এর মধ্যে হঠাৎ করেই গুরুদাসপুরে ১৭ জনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করলো পাকবাহিনী। যুদ্ধে যাওয়ার আঙ্খাকা আরও বৃদ্ধি পেলো।’

এই বীর যোদ্ধা বলেন, ‘এক বছরের ছেলে আর স্ত্রীসহ বাবা-মাকে রেখে বেরিয়ে পড়লার যুদ্ধের জন্য। ক্যাম্পে গিয়ে দেখা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল হোসেন, আনোয়ার হোসেন মাস্টার, আব্দুস সাত্তার, মকবুল, আনিসের সঙ্গে। সে সময় অধিনায়ক লতিফ মির্জা আমাকে নৌকা চালানো এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভাত রান্নার দায়িত্ব দিলেন। শুরু হলো দেশ মাতাকে মুক্ত করার লড়াই। কখনো কুচিয়ামারা ক্যাম্প, কখনো তাড়াশ, কখনো হান্ডিয়াল মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকায় নিয়ে নিয়োমিতভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকলাম’।

আক্ষেপ করে এই যোদ্ধা বলেন, ‘৭৫ রে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর তারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে পারেননি। মুক্তিযোদ্ধা বলে বেশ কয়েকবার পুলিশ ধরে নিয়ে নির্যাতন করেছে। এভাবেই চলছিল আপনঘরে পরাধীনতা। শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেন। রাজশাহীতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সমাবেশ করলেন। আমি সেই সমাবেশে ছিলাম। সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সমাবেশে শেখ হাসিনার বক্তৃতা শুনছিলাম। বক্তৃতায় শেখ হাসিনা বললেন, আপনারা কি আমার আব্বার মুক্তিযোদ্ধা। আমি হাত তুলে সাড়া দিলাম। শেখ হাসিনা বললেন, দুই হাত তুলে কথা দেন, আপনারা আমার সঙ্গে আছেন। আমরা তাই করলাম। তারপর শেখ হাসিনাকে ভোট দিলাম। তিনি সরকার গঠন করলেন। আমাদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বিকৃতি দিতে শেখ হাসিনা মুক্তি বার্তা প্রকাশ করলেন। তারপর থেকে আবার নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে শুরু করলাম।’

শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এই যোদ্ধা বলেন, শেখ হাসিনার দেওয়া সম্মানী ভাতার টাকায় তিনি সুখে দিনাতিপাত করছেন। বীর নিবাসে এখন তিনি পরিবার নিয়ে স্মার্ট জীবন যাপন করছেন। তিনি শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.