রায়হান আহমেদ তপাদার-ইংল্যান্ড- লেখক, গবেষক ও কলামিষ্ট ঃ শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড.মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন৷ বিশ্বব্যবস্থা, সমাজ এবং অর্থনীতি নিয়ে এই নোবেলজয়ীর রয়েছে বিশেষ ভাবনা৷ ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশ্বায়ন, সমাজ উন্নয়ন, নারী উন্নয়ন নানান খাতেই ড.মুহম্মদের ইউনূসের যুগান্তকারী ভাবনা বিশ্ব মহলে সমাদৃত৷বিশ্বয়নের এই যুগে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে অর্থনীতিবিদ ইউনূস সামাজিক ব্যবসা নিয়ে আরেকটি নতুন ধারণা দেন৷ এ বিষয়ে তার পরামর্শ হলো বহুজাতিক সামাজিক ব্যবসা৷ এই ব্যবসার মূল ধারণাটি হলো, এটি এমন এক ধরণের ব্যবসা, যা গরিবদের হাতে ব্যবসার মালিকানা তুলে দেবে অথবা ব্যবসার মুনাফা স্বল্পোন্নত দেশগুলোতেই থাকবে৷ পৃথিবীকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর উপযুক্ত অবস্থায় রাখার দায়বদ্ধতা থেকেই জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার জন্ম। তাই একদিকে যেমন সবার জন্য উৎপাদন ও ভোগের নিশ্চয়তা দিতে হবে, তেমনি অন্যদিকে প্রাকৃতিক সম্পদের পরিকল্পিত ও না হলেই নয় এমন ব্যবহারের মাধ্যমে পৃথিবী গ্রহের ক্ষতিসাধন রোধ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে কালক্ষেপণ করা যাবে না। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে দেশের তরুণ সমাজের প্রত্যাশা, জীবনবোধ ও জীবনীশক্তি অঙ্গাঙ্গী জড়িত। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে সব নাগরিকের জন্য যেসব অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, সেগুলোর মধ্যে আছে বৈষম্যমুক্ত মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান। আর্থসামাজিক উন্নয়নের দিক দিয়ে বিগত দশকগুলোতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য কিছু লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের প্রতি তৎকালীন সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ না থাকায় ওই অর্থনৈতিক অগ্রগতি দেশকে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন-বৈষম্য-বঞ্চনার অবাধ রাজ্যে পরিণত করে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্ভীক তরুণরা বৈষম্যহীন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বার্থে নেতৃত্বের হাল ধরার বিষয়ে অগ্রজ প্রজন্মের দীর্ঘদিনের ব্যর্থতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে অনেক শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবক আত্মাহুতি দিয়েছে। অসংখ্য আহত মানুষ এখনও বেঁচে থাকার কাতর আকুতিতে হাহাকার করছে। ন্যায্য অধিকার পাওয়ার জন্য কেন এত সম্ভাবনাময় শিশু-কিশোর, তরুণ ও যুবককে অমূল্য প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে? কেন এত আহত মানুষকে যন্ত্রণায় কাতরাতে হবে? নবীন-তরুণ ছাত্ররা দেখিয়ে দিয়েছে, রাষ্ট্র সংস্কারের ভিত্তিতে ন্যায়বিচারপূর্ণ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যপথে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা এই তরুণ ছাত্রসমাজ ধারণ ও লালন করে। রাষ্ট্রের সংস্কার বাস্তবায়ন করে ন্যায় বিচারপূর্ণ সমাজ গঠনের ভিত্তিতে সর্বস্তরের জনগণের জন্য নিরাপদ জীবিকা ও আত্মবিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করার নতুন লক্ষ্যে তরুণ ও প্রবীণদের নজিরবিহীন ঐক্য আমরা দেখতে পেয়েছি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা যথার্থ অর্জনের লক্ষ্যে বাস্তবানুগ রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য প্রয়োজন দক্ষ পেশাদারী অভিজ্ঞতা, নবাগত সতেজ প্রাণ তরুণ জীবনীশক্তির সমন্বয় এবং অগ্রাধিকারভিত্তিক সম্মিলিত পদক্ষেপ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনসংখ্যাবিষয়ক জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী নবীন ও তরুণের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৮.৬৭ শতাংশ এবং ২৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সীর সংখ্যা ২২.২৮ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের দেশে নবীন, তরুণ ও যুবার সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪০.৯৫ শতাংশ। দেশের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে এই বিপুলসংখ্যক নবীন, তরুণ ও যুবশক্তির ওপরে। আমাদের দেশে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে নেতৃত্বদানের অন্যতম চাবিকাঠি হতে পারে তরুণ প্রজন্মের জীবনবোধ, জীবনীশক্তি এবং প্রত্যাশা।
দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের কাছাকাছি জনগোষ্ঠীর বয়স যেহেতু ২৫ বছরের নিচে, সেহেতু দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে যে কোনো পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্ম ও ছাত্রসমাজের প্রত্যাশা, জীবনবোধ এবং জীবনীশক্তিকে যথাযথ মূল্যায়ন করা অবশ্যই জাতীয় কর্তব্য। বর্তমানে অনেক তরুণ প্রযুক্তি নির্ভর ক্ষুদ্র উদ্যোগ, অনলাইন বাণিজ্য এবং বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করছে। তরুণ প্রজন্মের উদ্ভাবন ও সৃজনশীল উদ্যোগকে যথাযথ আর্থিক, বাণিজ্যিক ও সামাজিক সহায়তা দিতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্য দিয়ে নবীন ও তরুণ প্রজন্মকে আগামী দিনের নেতৃত্বের হাল ধরার উপযুক্ত করে গড়ে তোলার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো, মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা। বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের স্বার্থে আগামীতে দেশকে বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির অন্যতম হাতিয়ার হলো প্রযুক্তি। প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে ক্রমাগত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খেতে সক্ষম সৃজনশীল মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্যোগও নেওয়া আবশ্যক। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে, ডলারের তীব্র সংকট চলছে, ঋণের নামে ব্যাংক লুটপাট আর বিদেশে দেদার অর্থপাচার অর্থনীতিকে মৃতপ্রায় করে দিয়েছে। পতিত সরকারের লোকজনের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের যে চিত্র প্রতিদিন প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে যেকোনো মানুষকে উদ্বিগ্ন হতে হয়। প্রশ্নবিদ্ধ পরিসংখ্যানের মাধ্যমে অর্থনীতির একটি ভালো চেহারা দেখানোর চেষ্টা এখন হাতেকলমে প্রকাশ পাচ্ছে।জনজীবনের সর্বত্র অস্বস্তি দৃশ্যমান। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে এখনো সাধারণ মানুষ রীতিমতো পিষ্ট অবস্থায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সাড়ে ১৮ লাখ কোটি টাকার ঋণ রেখে বিদায় নেওয়া পতিত সরকার বলা যায় ধ্বংস করে গেছে দেশের অর্থনীতি। বাজেটে ঘাটতি অর্থায়ন করার কারণে বিগত সরকার দেদার দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে। গত জুন মাস পর্যন্ত সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে ঋণের বোঝা বেড়েছে সাড়ে ৬ গুণ, যা বর্তমান বাজেটের ৩ গুণের সমান। যখন যেভাবে পেরেছে সেভাবেই দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে জাতীয় বাজেটের ভারসাম্যই নষ্ট করা হয়েছে। ফলে, বিপুল অঙ্কের অর্থ চলে যাচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধে। এদিকে ডলারের সংকট এখনো চলমান। ৮৬ টাকার ডলার ১২০ টাকায় উঠেছে। আমদানি খরচ বেড়েছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়লেও তা এখনো প্রয়োজনীয় রকম না। অর্থনীতির আকার অনুসারে পর্যাপ্ত রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি অর্থনীতিকে অভেদ্য এক চক্রে ফেলে দিয়েছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিতে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই অন্তর্বর্তী সরকারকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে জনগণকে অভয় দিতে হবে। যতদূর বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অনেকটাই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধপরবর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত এক অবস্থায় আছে। পার্থক্য এতটুকু, তখন পাকিস্তানিরা শোষকশ্রেণি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে ভুল করে ১৮ মার্কিন ডলার রেখে গিয়েছিল, এখন ২০২৪ সালে বিবিতে প্রশ্নসাপেক্ষ ১৮-২০ বিলিয়ন ডলার আছে।২০০৯ সাল থেকে দেশের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের বেশি। ২০২১ সালে মাথাপিছু আয়ে ভারতকেও ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ; কিন্তু এর পরও দেশটিতে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই সমানভাবে পাননি।
সাম্প্রতিক অস্থিরতা দেশটির পোশাক খাতকে বড় একটি নাড়া দিয়েছে। সহিংসতার সময় পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ ছিল। বাংলাদেশে পোশাক কারখানা আছে সাড়ে তিন হাজার। দেশটির বার্ষিক সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি ডলারের রপ্তানির মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে পোশাক রপ্তানি থেকে। বিশ্বের শীর্ষ খুচরা পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক অস্থিরতার মধ্যে মার্কিন প্রতিষ্ঠান হুলা গ্লোবাল জানিয়েছে, কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশের বদলে অন্য দেশে দিয়েছে তারা। অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে কাজ শুরু করবে বলে আশা করছি এবং নতুন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হবে। যেই ব্যবস্থার ওপর আস্থা থাকবে মানুষের।সময়ের হিসাব করলে, নানা সূচক যোগ-বিয়োগ করলে রিজার্ভের অবস্থা সম্ভবত আরও খারাপ অবস্থায় আছে। তারপরও জনগণের সীমাহীন এই সরকারের প্রতি প্রত্যাশা। এমনই এক প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে কী করণীয়, তা নিয়ে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। সবারই মত, অর্থনীতিতে আমূল পরির্বতন আনতে হবে। অর্থনীতির কাঠামোগত সংস্কার সাধন করতে হবে। তবে সবার আগে মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্রের মৌলিক কিছু সমস্যায় প্রথম নজর দিতে হবে। এসব সমস্যা নিয়ে নির্মোহ অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরেই পরামর্শ দিয়েছেন, বলে আসছেন।
সেসব পরামর্শ হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারের কথিত উপকারকারী গোষ্ঠী ও মানুষের ‘বিরোধী’ খোঁজার মহা এক উৎসবের আড়ালে চলে গেছে। তাই সরকারকে সাবধানে, সবদিক পর্যালোচনা করে এগোতে হবে। এ জন্য সর্বাগ্রে নীতি বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হিসেবে অর্থনীতির মূল খাত ও ক্ষেত্রগুলোর অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষণ পরিচালনা করতে হবে, যা সরকার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ক্রিয়াকলাপের অবস্থার মূল্যায়ন করবে, দুর্বলতা ও ব্যর্থতা চিহ্নিত করবে। অর্থাৎ সমস্যার মূলগুলো নথিভুক্ত করে প্রকৃত লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আশুপরিবর্তনগুলো সারিবদ্ধ করে, সে অনুযায়ী প্রতিকারের কাজ শুরু করতে হবে।