আকস্মিক বন্যা ও বাংলাদেশ-ভারত জটিলতা

রায়হান আহমেদ তপাদার-লেখক, গবেষক ও কলামিষ্ট ঃ সম্প্রতি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলার অনেকগুলো উপজেলা আকস্মিক বন্যায় ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়েছে। কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। তাঁদের বাঁচানোর জন্য অনেক আহাজারির কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এতটাই করুণ, যা কল্পনাতীত। এ বছর দেশের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বন্যা আমরা দেখেছি। বাংলাদেশে ও ত্রিপুরা রাজ্যের ওপরে যে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি ও বন্যা হয়েছে তার মুল কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এল-নিনো,মেডেন-জুলিয়ান দোলন, জেট স্ট্রিম এবং বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট মৌসুমি লঘু চাপের জন্য এমনটি হয়েছে। আবহাওয়াসম্পর্কিত এই বিষয়গুলোর প্রতিটি কারণই পৃথক পৃথকভাবে যথেষ্ট বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য দায়ী। দৈবক্রমে আগস্ট মাসের পনের তারিখের পর থেকে একই সঙ্গে চারটি বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ওপর একই সময় সক্রিয় অবস্থায় উপনীত হয়ে চারটি বৈশিষ্ট্যের মিলিত প্রভাবে রেকর্ড পরিমাণে বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে। তবে কথা হচ্ছে, এসব আমরা কেন জানতে পারলাম না। আবহাওয়ার পূর্বাভাসবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে বর্তমানে ৩ থেকে ১৫ দিন পূর্বের আবহাওয়া পূর্বাভাস করা যায় অনেক নিখুঁতভাবে। ৩ দিন আগে থেকে শতকরা ৯০ ভাগ নিশ্চয়তাসহকারে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া যায়। গত সপ্তাহে যে বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা রাজ্যের ওপর রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হলো, তার পূর্বাভাস ১০ দিন পূর্বে দেওয়া সম্ভব ছিল। বাংলাদেশের মানুষকে ভারী বৃষ্টির এই পূর্বাভাস জানাতে ব্যর্থতার জন্য পুরোপুরি দায়ী বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। কেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এই পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হলো, সেই ব্যাখ্যা বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদদের কাছে জানতে চাওয়া উচিত।

বাংলাদেশ ও ভারতের বৃষ্টিপাত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে ফেনী, কুমিল্লা ও ত্রিপুরা রাজ্যের ওপর গড়ে ৪৫০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছে ৩ দিনে। এখানে উল্লেখ্য যে আগস্ট মাসে কুমিল্লা জেলায় বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩৪৭ মিলিমিটার ও ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলায় বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪০৩ মিলিমিটার। অর্থাৎ ১৯ আগস্ট থেকে শুরু করে ২২ আগস্ট পর্যন্ত ৩ দিনে কুমিল্লা ও ফেনী জেলায় মোট যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তা এই দুই জেলার আগস্ট মাসের মোট বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি। এই রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিই হলো রেকর্ড পরিমাণ বন্যার প্রধানত কারণ। তার সাথে যুক্ত হয়েছে,ত্রিপুরায় বন্যা ও বাঁধ খুলে দেওয়া। কুমিল্লা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদী ও ফেনী জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত মুহুরী নদীর উজানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে একাধিক বাঁধ দিয়েছে দেশটির সরকার। সেখানে আছে ব্যারেজও। এসব বাঁধ ও ব্যারেজের কোনোটি পানি সংরক্ষণের জন্য, কোনোটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কিংবা কৃষিকাজের জন্য। যেহেতু জুন মাসে বর্ষা মৌসুম শুরু হয়েছে, তাই ১৮ আগস্টের আগেই এসব ড্যাম ও ব্যারাজ পানিতে পূর্ণ ছিল। ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২০ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ২০০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের কারণে ত্রিপুরা রাজ্যের সব ড্যাম ও ব্যারাজের পানি ধারণক্ষমতার সীমায় পৌঁছে যায় এবং ২০ আগস্ট রাতে হঠাৎ করেই বেশির ভাগ ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খুলে দেয় ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃপক্ষ। ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃপক্ষ কিংবা ভারত সরকার ভাটি অঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারকে ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খুলে দেওয়া সম্পর্কে আগে থেকে কোনো রকম তথ্য দেয়নি বা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য যে মেডেন-জুলিয়ান নামক আবহাওয়া চক্রটি আগামী দুই সপ্তাহ ভারত মহাসাগরের ওপর সক্রিয় অবস্থায় থাকবে, যার প্রভাবে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ওপর নিয়মিত বর্ষা মৌসুমের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।অনেকেই বলছেন, আচমকা বন্যায় মানুষ হতবাক হয়ে গেছে। ৩৬ বছর আগে ১৯৮৮ সালে এখানকার মানুষ বন্যা দেখেছিল। তবে সেই বানের পানি এবারের মতো ‘হই হই করি ছুটে আসেনি।স্বাভাবিক বন্যার পানি নদীর মধ্যে তর্জন-গর্জন করতে পারে, ঢেউ তুলতে পারে। কিন্তু যখন সে কূল উপচিয়ে মাঠে আর গ্রামে নামে তখন তার তর্জন- গর্জন আর গাঙের মতো থাকে না। তবে কোথাও বাধা পেলে সে আবার কঁকিয়ে ওঠে। ফেনী, কুমিল্লা আর হবিগঞ্জের বন্যায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আটকে রাখা পানি। দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার কলসিতে মুহুরী নদীর পানি আটকে রাখার জলাধার বা ব্যারাজ আছে। ব্যারাজ আছে গোমতীর উজানে ত্রিপুরার ডুম্বুর এলাকায়। এই দুটি ছাড়াও এদের অববাহিকায় উপনদীগুলোতেও আছে নানা আকারের জল আটকানোর ব্যবস্থা। অতি বৃষ্টিতে জলাধারের চাপ সামলানোর জন্য এবং নিজের চাপে নিজের অক্কা পাওয়া ঠেকাতে খুলে দিতে হয় ব্যারাজগুলোর জলকপাট। এবারের অতিবৃষ্টির বন্যা যে ড্যাম-ব্যারাজ খোলার জন্যই বিপর্যয়কর হয়েছে, সেটা বোঝা যায় স্রোত দেখে। ‘ক্রুদ্ধ বিদ্রোহী’ জলে মুহূর্তে ডুবে যেতে থাকে গ্রামের পর গ্রাম আর শহরের জনপদ। যা-ই হোক, কী ক্ষতি হয়েছে তা এখন আন্দাজ করা কঠিন। আসল ক্ষতিটা বোঝা যাবে পানি সরে যাওয়ার পর। তারপরও আগাম খবর পেলে আমরা অন্তত জানতে পারতাম, অন্য রকমের বিপদ আসছে।বাংলাদেশকে জানানোর জন্য ভারত বাধ্য কি না এমন প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, না। কারণ তাদের সঙ্গে আমাদের তেমন কোনো চুক্তি নেই।

নদীর পানি বণ্টন আর খবরাখবর নেওয়ার ভিত্তি আইন হচ্ছে ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ সনদ। এটাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পানি সংক্রান্ত সবচেয়ে বড় আইন। ভারত এই আইনে স্বাক্ষরই করেনি। আমরা স্বাক্ষর করেও অনুসমর্থন করিনি। অনেকে বলেন, ভারতের চাপে এটা আমরা করিনি। ভারতকে পানি বণ্টনে বাধ্য করতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বাইরে বহুপক্ষীয় আলোচনায় টেনে নেওয়ার সুযোগ থাকলেও আমাদের হিম্মত নেই। জলবায়ু পরিবর্তন এবং আমাদের অভ্যাস অপরিবর্তিত থাকার কারণে এ ধরনের বিপর্যয় ঘন ঘন আসবে। আমাদের অবস্থানের সাথে মনকে ঠিক করে কাজে নামতে হবে।
যাইহোক,কয়েক দিনের একটানা ভারি বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে দেশের ৯টি জেলা ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে ফেনী, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, হবিগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজার। এসব জেলার প্রায় সব নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ৩০ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব জেলাগুলোতে বন্যায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে ঢাকার রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। খবরে জানা যায়, ফেনী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পানিতে ডুবে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। আবহাওয়া বিভাগ বলেছে, বাংলাদেশের ওপর মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় ও লঘুচাপের প্রভাবে ভারি বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। যদিও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছুটা কমে আসতে পারে বলে তারা ধারণা করছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, এই বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনীর তিনটি উপজেলা। এগুলো হচ্ছে পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা। এসব উপজেলার রাস্তাঘাট, ফসলি জমি, মাছের ঘের তলিয়ে গেছে।

মাস দেড়েক আগেও বন্যায় এই জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বেশ কিছু বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। সেসব বাঁধ দিয়ে এবার দ্রুত পানি প্রবেশ করায় সব কিছু এত তাড়াতাড়ি তলিয়ে যায় যে মানুষ খাদ্যদ্রব্যসহ মূল্যবান মালপত্র সরানোরও সময় পায়নি। ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে প্রবল বর্ষণ, উজানের ঢলের পাশাপাশি জোয়ারের পানিও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছে। কুমিল্লায় গোমতীর বাঁধের ভেতরেও পানি ঢুকে পড়েছে। বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে রোপা আমনেরও অনেক ক্ষতি হয়েছে। খবরে জানা যায়, ডম্বুর ও গজলডোবা বাঁধ হঠাৎ খুলে দিয়ে বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যা সৃষ্টির প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, বাংলাদেশকে না জানিয়ে ত্রিপুরার ডম্বুর বাঁধের সবগুলো গেট খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশের ফেনী ও আশপাশের অঞ্চলে হঠাৎ পানির প্রবল চাপ সৃষ্টি হয় এবং বন্যা দেখা দেয়। অতীতে একই ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে তিস্তার উজানে থাকা গজলডোবা বাঁধ হঠাৎ খুলে দেওয়ার কারণে। শিক্ষার্থীরা দাবি করেছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে থাকা অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ন্যায্য পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে হবে এবং নদীগুলোতে থাকা সব অবৈধ বাঁধ অপসারণে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নিতে হবে। অতীতে অনেক গবেষণায়ই উঠে এসেছে, বাংলাদেশে অন্য সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মিলে যত ক্ষয়ক্ষতি হয়, শুধু বন্যায় তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়। আর বন্যার ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয় আমাদের নদীগুলো নাব্য না থাকার কারণে। পলি জমতে জমতে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষার ও উজানের ঢলের পানি নদী দিয়ে নামতে পারে না, তখন নদীর দুই পারে থাকা জনবসতি ও ফসলি জমি ভাসিয়ে পানি সাগরে যায়। তাই নদীগুলো নাব্য করার উদ্যোগ নিতে হবে।

তবে এখন যা করতে হবে, তা হচ্ছে, দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। খাদ্য ও পানীয়জল সরবরাহ করতে হবে। বন্যা-পরবর্তী রোগব্যাধি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রাখতে হবে। অনেকেই বলছেন, আচমকা বন্যায় মানুষ হতবাক হয়ে গেছে। ৩৬ বছর আগে ১৯৮৮ সালে এখানকার মানুষ বন্যা দেখেছিল। তবে সেই বানের পানি এবারের মতো হই হই করে ছুটে আসেনি। তাই এমন আকস্মিক বন্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ-ভারত যে জটিলতা রয়েছে তার দীর্ঘস্থায়ী সুষ্ট সমাধান খুঁজতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.