আরেকবার প্রমাণিত হলো জনগণই ক্ষমতার উৎস

রায়হান আহমেদ তপাদার-লেখক, গবেষক ও কলামিষ্ট ঃ বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এসব প্রতিক্রিয়ায় তাদের কেউ কেউ বাংলা দেশের জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে, আবার কেউ বাংলাদেশের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের কথা পুনরুল্লেখ করে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে এমন আশা প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত এবং পাকিস্তান যেমন রয়েছে, তেমনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইইউ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। পদত্যাগের পর ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত শেখ হাসিনা দেশটির রাজধানী দিল্লিতে রয়েছেন। হাসিনার সরকার পতনের পর বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো। বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমে ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়টি এসেছে। এ ছাড়া শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার আগমুহূর্তেও কীভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন, তার বিবরণ এসেছে। কেন তাঁর এমন পরিণতি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, সেই কারণও খোঁজার চেষ্টা করেছে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম। ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা যেভাবে স্বৈরশাসক হয়ে উঠেছিলেন, তাতে তাঁর এমন পতন ছিল অনিবার্য। স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিরোধীদের দমন, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের কণ্ঠরোধ এবং বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিক্ষুব্ধ জনতার গণভবনমুখী মিছিলের ঠিক আগমুহূর্তে পরিবারের সদস্যদের আহ্বানে দেশ ছেড়ে পালান শেখ হাসিনা।
বিক্ষোভকারীদের নির্বিচার হত্যা নিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ শুরু করলেও শেখ হাসিনা জোরপূর্বক ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়ে ছিলেন।এমন পরিস্থিতিতে সামরিক নেতৃত্বে তাকে বোঝায় এটা করলে রক্তপাত আরও বাড়বে।কিন্তু তিনি তা মানতে চাচ্ছিলেন না। দ্য ডন-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা নির্দেশ দিলেও বিক্ষোভ দমনে বল প্রয়োগে অস্বীকৃতি জানায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। আর এর মধ্য দিয়েই শেখ হাসিনার ভাগ্য নির্ধারিত হয়। সংবাদ মাধ্যমটি বিভিন্ন প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জানায়, বিক্ষোভ দমনে গুলি না চালানোর সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দিন আগেই নিয়েছিল সেনাবাহিনী। এরপর সেনাপ্রধান শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করার বিষয়ে পরামর্শ দেন ও পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করেন। এতেও শেখ হাসিনা রাজি না হয়ে বলপ্রয়োগেই জোর দেন।তরুণ প্রজন্ম কীভাবে শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করল, সেই ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আজ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আল-জাজিরা। তাতে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন কীভাবে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমনের সর্বাত্মক চেষ্টা শেখ হাসিনার সরকার করেছে, তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে সূত্রের বরাতে বলা হয়, পদত্যাগের পর পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনা সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ফিনল্যান্ড সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন। তাতে আরও বলা হয়, এর আগে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নতুন নেতা কে এই মুহাম্মদ ইউনূস শিরোনামে আজ গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের একজন সমালোচক ও গরিবদের ব্যাংকার হিসেবে পরিচিত শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড.মুহাম্মদ ইউনূস দেশটিতে নতুন একটি নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

৮-ই আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে।এবং রাতে শপথ নিয়েছেন ড.ইউনূস সহ আরও ষোল সদস্য।শেখ হাসিনাকে অনেকে গত এক যুগ ধরে ‘আয়রন লেডি’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। সাড়ে ১৫ বছর যাবৎ দোর্দণ্ড প্রতাপে ক্ষমতায় টিকে থাকা একজন প্রধানমন্ত্রী এভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন সেটি অনেকে ধারণাই করতে পারেননি। বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষমতাচ্যুত হবার পর কোনো ব্যক্তি এভাবে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হননি। ৫ আগষ্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ডাকে ‘লং মার্চ টু’ ঢাকা কর্মসূচির সময়ে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা পলিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই ঘটনা ঘটার আগে অনেক নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘাতে প্রায় ১০০ মানুষ নিহত হয়। বেশ কিছু পুলিশ সদস্যও নিহত হয়েছিলেন। ঐদিন বিকেলে আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও উপদেষ্টা শেখ হাসিনাকে জানান যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।বিক্ষোভারীদের প্রতিরোধের মুখে বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতারা পিছু হটেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা পরিস্থিতি মানতে নারাজ ছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে শক্তি প্রয়োগ করে। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে ধারণা দিয়েছেন যে এটি আর সামাল দেয়া যাবে না। তারপরেই তিনি পদত্যাগ করার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নেন। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, রবিবার থেকে তার মা পদত্যাগের কথা চিন্তা করছিলেন।সামরিক বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শেখ হাসিনা কখন পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেছেন এবং কখন হেলিকপ্টারে উঠেছেন সেটি কেবলমাত্র জানতেন স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স, প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট এবং সেনা সদরের কিছু ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা। পুরো বিষয়টি করা হয়েছিল বেশ গোপনে।

সেনাবাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগষ্ট বেলা ১১টার মধ্যেই শেখ হাসিনা গণভবন ছেড়ে গেছেন। সেখান থেকে বাংলাদেশের হেলিকপ্টারে করে ত্রিপুরার আগরতলা পৌঁছেন। এরপর ভারতের বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে চেপে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দিল্লি পৌঁছান। বুঝা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা তার হাতে দুটো অপশন খোলা রাখতে চেয়েছেন। দেশ ছেড়ে যাবার ব্যাপারে প্রস্তুতিও ছিল এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বল প্রয়োগ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আর বেশি হতাহত হোক সেটা চাননি। ঐদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষ এবং বিক্ষোভকারীরা সেনাবাহিনীর মাঠ পর্যায়ের সৈনিক ও কর্মকর্তাদের সাথে মিশে গিয়েছিল। সে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন যে পরিস্থিতি ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। গণভবনমুখী সবগুলো রাস্তায় অনেক দূর থেকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিল। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা যাতে নিরাপদে তেজগাঁও বিমান বন্দরে ঢুকতে পারেন সেজন্য এ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। অন্যদিকে, সকাল নয়টার দিকে দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয় দেড় ঘণ্টার মতো। শেখ হাসিনার গতিবিধি সম্পর্কে যাতে কোনো খবরা-খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে ওঠার পর থেকে ইন্টারনেট সংযোগ সচল করা হয়। সংবাদ মাধ্যম বলছে, শেখ হাসিনা ঐদিন সকালে তিন বাহিনীর প্রধান ও পুলিশ প্রধানের সাথে একসাথে বৈঠক করেন গণভবনে। নিরাপত্তা বাহিনী কেন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না, সেটার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। একপর্যায়ে শেখ হাসিনা আইজিপিকে দেখিয়ে বলেন, তারা তো ভালো করছে।

তখন আইজিপি জানান, পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গেছে, তাতে পুলিশের পক্ষেও আর বেশি সময় এ রকম কঠোর অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব নয়। ততক্ষণে লাখো বিক্ষোভ কারী রাস্তায় জড়ো হয়ে গেছে। সামরিক বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শেখ হাসিনাকে জানানো হয়েছিল যে মানুষজনকে বেশি সময় আটকে রাখা যাবে না এবং তারা গণভবনের দিকে রওনা হবেন। সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনার জীবন বিপন্ন হতে পারে। শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন, ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি যদি বল প্রয়োগ করে ঠেকিয়ে রাখা যায়, তাহলে তিনি পদত্যাগ করবেন না। একইসাথে যদি তিনি ব্যর্থ হন তাহলে দেশ ছাড়ার প্রস্তুতিও রেখেছিলেন। কর্মকর্তারা বলেন, দেশ ছাড়ার ব্যাপারে ভারতের সাথে আগেই যোগাযোগ করা হয়েছিল।ভারতের তরফ থেকে জানানো হয়েছিল যে বাংলাদেশের হেলিকপ্টারে করে তিনি যদি ভারতের আগরতলায় পৌঁছাতে পারেন, তাহলে সেখান থেকে তাকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হবে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি পরিবহন বিমানে করে শেখ হাসিনাকে ৫ আগষ্ট দিল্লি হিন্ডোন বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়।শেখ হাসিনার ছেলে সজীব বলেন,তার মা দেশ ছাড়তে চাননি। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। সেজন্য তাকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার কথা জোর দিয়ে বলেন পরিবারের সদস্যরা। ঐদিন সকালে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর প্রধানরা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে রাজি করানোর জন্য তার বোন শেখ রেহানার সাথেও আলোচনা করেন। তখন কর্মকর্তারা শেখ রেহানার সঙ্গে আরেক কক্ষে আলোচনা করেন। তাকে পরিস্থিতি জানিয়ে শেখ হাসিনাকে বোঝাতে অনুরোধ করেন। শেখ রেহানা এরপর বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে অনড় থাকেন। একপর্যায়ে বিদেশে থাকা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গেও ফোনে কথা বলেন একজন শীর্ষ কর্মকর্তা। এরপর জয় তার মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর শেখ হাসিনা পদত্যাগে রাজি হন।

হাসিনার পদত্যাগের পর ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত শেখ হাসিনা দেশটির রাজধানী দিল্লিতে রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ ব্যাপারে ধৈর্য প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রশংসা করেছে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আহবান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আহবান জানিয়ে আসছিলো এবং তারা গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তি মূলক একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাজ্যের ফরেন কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিসের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বাংলাদেশে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও প্রাণহানি রোধ করতে সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে।চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেছেন। বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী এবং কৌশলগত উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে চীন আন্তরিক ভাবে আশা করে যে, বাংলাদেশে দ্রুত সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। তবে এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান নোবেল বিজয়ী ড.ইউনুস দেশকে কোনদিকে এগিয়ে নিয়ে যান। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের মানুষের চেতনা ও ঐক্য দেশকে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.