তমালিকা মল্পালিক ঃ নি জীবন ধারনের একটি মৌলিক উপাদান। অবস্থানগত ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে সুপেয় পানির অত্যন্তসংকট। এই সংকট দক্ষিণ–পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় সবচেয়েবেশী। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ সুপেয় পানির জন্যবৃষ্টির উপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টি কম হলেপুকুরের পানিও কমে আসে, পানির গুণগতমান নষ্ট হয়। ফলেসুপেয় পানি পাওয়া প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। দক্ষিণাঞ্চলেসুপেয় পানির নিশ্চয়তার দাবিতে বিশ্ব পানি দিবস ২০২৪উদযাপন উপলক্ষ্যে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে বিভিন্নসংগঠন ও শ্রেণী পেশার মানুষ। ২২ মার্চ একযোগে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের বিভিন্ন জায়গায় এই পানি দিবস ২০২৪ উদযাপন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলাতে একযোগে লিডার্স ও উপজেলা জলবায়ু অধিপরামর্শ ফোরামের উদ্যোগে শ্যামনগরমাইক্রো স্ট্যান্ডে মানববন্ধন ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়। উক্ত মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মাষ্টারনজরুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব দেবীরঞ্জন মন্ডল, উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জনাব খালেদা আইয়ুব ডলি, শিক্ষক ও সাংবাদিক জনাব রণজিৎ কুমার বর্মন, শিক্ষক জনাবমানবেন্দ্র দেবনাথ, জনাব আবু সাইদ, বিভিন্ন সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সহ আরো অনেকে। মানববন্ধনেউপস্থিত সকলে খালি কলস নিয়ে দাঁড়িয়ে সুপেয় পানিরনিশ্চয়তার দাবিতে প্রতীকী প্রতিবাদ জানায়।
আশাশুনি উপজেলাতে একত্রে লিডার্স ও উপজেলা জলবায়ুঅধিপরামর্শ ফোরামের উদ্যোগে পানি দিবস ২০২৪ উপলক্ষ্যেমানববন্ধন ও সমাবেশ এর আয়োজন করা হয়। সমাবেশেউপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব, মোঃ আব্দুল হান্নান,জনাব বিকাশ চন্দ্র সানা, ইউ পি সদস্য জনাব মারুফা বেগম, মিনতি রাণী সরকার সহ আরো অনেকে। তারা সরকারের কাছেউপকূলের সুপেয় পানির সংকট নিরসনের দাবি জানান।
খুলনা জেলার পাইকগাছাতে সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষাআন্দোলন ও লিডার্সের যৌথ উদ্যোগে অনির্বান লাইব্রেরিতেপানি দিবস ২০২৪ উপলক্ষ্যে শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানেসভাপতিত্ব করেন খুলনা-৬ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য মোঃরশীদুজ্জামান। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন প্রফেসর রেজাউলকরিম, বিভিন্ন সুধী সমাজের নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক, শিক্ষকসহআরো অনেকে। খুলনা-৬ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য মোঃরশীদুজ্জামান তার বক্তব্যে বলেন যে, পরিবেশে পানির ভারসাম্যধরে রাখতে হবে। আর তার জন্য আমাদের পানির সঠিক ব্যবহারএর উপর গুরুত্ব দিতে হবে। প্রকৃতি কে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
বাগেরহাট প্রেসক্লাবের সামনে লিডার্স ও জেলা জলবায়ুঅধিপরামর্শ ফোরামের যৌথ উদ্যোগে সুপেয় পানির নিশ্চয়তারদাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ এর আয়োজন করা হয়। এসময়বাগেরহাট জেলা জলবায়ু অধিপরামর্শ ফোরামের সদস্যরাউপস্থিত ছিলেন। বাগেরহাটের মোংলাতে পশুর রিভারওয়াটারকিপার ও লিডার্সের আয়োজনে র্যালি, মানব বন্ধন ও গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। গোলটেবিল বৈঠকেসভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব নারায়নচন্দ্র পাল। গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেনমোংলা পোর্ট পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুররহমান। গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেনসহকারি কমিশনার (ভূমি) মোঃ হাবিবুর রহমান, মোংলা সরকারিকলেজের অবসরপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ বিভাষ চন্দ্র বিশ্বাস ও মংলাটেকনিক্যাল কলেজ’র অধ্যক্ষ মোঃ সেলিম। গোলটেবিল বৈঠকসঞ্চলনায় ছিলেন পশুর রিভার ওয়াটারকিপার পরিবেশযোদ্ধামোঃ নূর আলম শেখ। গোলটেবিল বৈঠকে অন্যান্যদের মধ্যেবক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশ্বাস রনজিত কুমার, ব্রাক’রশফিকুর রহমান স্বপন, মোংলা সরকারি কলেজের প্রভাষকশ্যামা প্রসাদ সেন, ড. অসিত বসু, ড. অপর্ণা অধিকারী, প্রভাষকসাহারা বেগম, লিডার্স এর কৌশিক রায় সহ আরো অনেকে।
পানি দিবসের বিভিন্ন কর্মসুচীতে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশেরউপকূলবর্তী ১৯ টি জেলায় প্রায় ৩ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষেরবসবাস। আধারযোগ্য পানি সংগ্রহ করতে পারে না এদের প্রায় ৩ কোটি মানুষ এবং দেড় কোটি মানুষ ভুগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি পানেবাধ্য হচ্ছেন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মতে যেখানেপানযোগ্য প্রতি লিটার পানিতে লবণের সহনীয় পরিমান ০ থেকে১ হাজার মিলিগ্রাম সেখানে বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিলিটারপানিতে রয়েছে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার মিলিগ্রাম লবণেরউপস্থিতি।
মানববন্ধন ও সমাবেশে বক্তারা আরও বলেন, নদীভাঙন জনিতবন্যা, চিংড়ি চাষ, ভুগর্ভস্থ পানির লবনাক্ততার কারনে গতকয়েক বছরে সুন্দরবন এলাকায় সুপেয় পানির সংকট বেড়েছে।সুন্দরবন উপকুলে ৭৩% পরিবার সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত বাখারাপ পানি খেতে বাধ্য হয়। উপকূলীয় অঞ্চলে গত ৩৫ বছরেলবণাক্ততা পূর্বের তুলনায় ২৬% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং যার পরিমান২ পিপিটি থেকে বেড়ে ৭ পিপিটি হয়েছে। বাংলাদেশেরদক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্র থেকে ভূভাগের অনেক ভিতর পর্যন্তলোনাপানি ঢুকে পড়েছে, ফলে লোকজনকে পানি ও খাবারেরসাথে তুলনামূলক বেশি পরিমাণে লবণ গ্রহণ করতে হচ্ছে।এছাড়া লবাণাক্ততা বৃদ্ধি এ অঞ্চলের মানুষকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতেওফেলেছে। চিকিৎসাবিদদের মতে এ এলাকার বসবাসকারীদেরউচ্চ রক্তচাপ রোগে ভোগার সম্ভাবনা বাড়ছে। গবেষণায় দেখাগেছে লবণাক্ততায় আক্রান্ত এলাকায় গর্ভবতী মায়েদের প্রি–একলেম্পশিয়া ও উচ্চরক্তচাপের হার ৬.৮%-৩৯.৫% বেড়েছে।লবণাক্ততার কারনে উপকূলের নারীদের জরায়ু সংক্রমন বেড়েছেআশঙ্কাজনকভাবে। মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে খাবার পানিসংগ্রহ করতে হচ্ছে নারীকেই। ফলে নষ্ট হচ্ছে নারীর শ্রমঘন্টা।শিশুদের অনিরাপদ অবস্থায় রেখে যেতে হচ্ছে ও নারীরা যৌনহয়রানির শিকার হচ্ছে। শিশুদের শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। রোগব্যাধিবাড়ছে, সামগ্রিক জীবনের গুণগত মান হ্রাস পাচ্ছে।
দক্ষিণ–পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির জন্য বক্তারা যেসকল দাবী তুলে ধরেন, বাংলাদেশ পানি আইনের ধারা-১৭ অনুযায়ী উপকূলীয় অঞ্চলকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবেঘোষণা করতে হবে। নিরাপদ পানির সর্বজনীন, ন্যায্য ও সজলভ্যতা নিশ্চিত করতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি ও অগ্রাধিকারপ্রকল্প গ্রহণ করতে হবে এবং ২০২৩–২৪ অর্থ বছরে বাজেটেবিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে, উপকুলীয় সকল মানুষের খাবার পানিরটেকসই ও স্থায়ী সমাধান করতে হবে, আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়সাধনে উপকূল উন্নয়ন বোর্ড গঠন করতে হবে, পানীয় জলেরউৎসের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে, উপকূলীয় অঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্পগ্রহণ এবং বাস্তবায়নের পূর্বে ওই এলাকার পানির চাহিদাযোগানের পরিকল্পনা নিশ্চিত করতে হবে।