“নূরজাহান নীরা”
আনিসুর রহমান, বেনাপোল যশহর প্রতিনিধি ঃ শীতকালের কথা বলতেই যে জিনিসটার কথা আগে মনে পড়ে তা হলো খেজুরের রস। শীত মানেই খেজুরের রস। কনকনে শীতের সকালে এক গ্লাস খেজুরের রসের তৃষ্ণা যেনো বাঙালির আজন্ম ধারায় মিশে আছে ।খেজুর রসের পিঠা পায়েস ছাড়া যেনো শীতকাল অসম্পূর্ণ থেকে যায়।গ্রামীণ জনপদ রসের ম ম গন্ধে ছেঁয়ে থাকে শীতেরসময়টায়।কুয়াশা জড়ানো ভোরে গাছিরা পেড়ে আনেন রস।রোদ পেলে রসে গাঁজন তৈরী হয়, রস টক ও ঝাঁঝাল হয়ে যায় তাই কুয়াশা থাকতেই রস পেড়ে আনতে হয়।রোদ্র বাড়ার আগেই খাওয়া হয় কাচা রস। রস অল্প জ্বালিয়ে তাতে ভেজানো হয় চিতই পিঠা।করা হয় রসের পায়েস।রস জ্বালিয়ে বানানো হয় গুড়।রস ঘন হতে শুরু হলে সেই রস তুলে তা দিয়ে মুড়ি,খই,ও চিড়ার মোয়া বানানো হয়।এই গুড়কে চিটাগুড় বলা হয়।খেজুরের গুড় দিয়ে ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা বানানো হয়।শীতের সকালে রসে ভেজা রসচিতই বা গরম গরম ভাপা পিঠা শীতের সকালের ক্লান্তি দূর করে মনকে রাঙিয়ে দেয়।এই খেজুরের রস হলো খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহকৃত রস।শীত পড়তে শুরু করলেই গাছ থেকে রস বের হওয়া শুরু হয়। তাইতো শীত আসার আগেই হেমন্তের শুরু থেকে গাছিরা প্রস্তুতি নিতে থাকেন।বিশেষ পদ্ধতিতে কয়েকটা ধাপে গাছিরা এটা করেন। মোটা দড়ি,বেশ ধারালো দুটি দা,রস সংগ্রহের জন্য মাটির হাঁড়ি বা ভাঁড়, বাঁশের নলি যা দিয়ে রস গড়িয়ে পড়ে,ভাঁড়আটকানোর জন্য বাঁশের খিল যেটা গাছের মাথার নরম অংশে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় হাঁড়ি বাঁধার জন্য , দা রাখার জন্য বাঁশের বানানো গোলাকার ঝুুড়ি,ভাঁড় রাখার জন্য একটা বাঁশের আংটা এগুলো জোগাড় করেন গাছিরা।এরপর প্রথমে গাছের পাতা ছাটাই করে পরিস্কার করা হয়।এর কিছুদিন পর আবার কয়েকটা পাতা ছাটাই করে রসসংগ্রহের জায়গাটা নির্দিষ্ট করা হয়।এর মাঝে রস সংগ্রহের জন্য মাটির হাঁড়ি বা ভাঁড় প্রস্তুত করা হয়।ভাঁড় ভালোভাবে পরিস্কার করে রোদে শুকাতে হয়।যাতে কোনো ছত্রাক বা পোকামাকড় না থাকে। যতদিন রস সংগ্রহ করা হয় ততদিন ভাঁড় ধুয়ে রোদে শুকিয়ে তাতে আগুনের তাপও দেওয়া হয়। গাছের মাথায় ত্রিভুজের আকারে বেশ গর্ত করে কাটা হয়। এই গর্তের মাঝ থেকে ত্রিভূজের কোণে রস গড়িয়ে আসে।আর এই কোণায় লাগানো হয় বাঁশের নলিটা, নলির নালা বেয়ে রস পড়ে ভাঁড়ে।আর ভাঁড় ঝুলানো থাকে খিলে।তিন থেকে চারদিন পর পর গাছের মাথায় ঐ ত্রিভুজাকৃতির গর্তটা কাটতে হয়।এর জন্য দরকার হয় খুব ধারালো পাতলা দা আর ভারী দা দরকার হয় গাছের পাতা কাটতে।একবার কেটে তিন থেকে চারদিন রস পাওয়া যায়।কয়েকদিন পর পর এভাবে কাটাকে চাচ দেওয়া বলে।যে দিন চাচ দেওয়া হয় সেদিন রস অনেক বেশি হয় এবং এই রসটা অনেক বেশি বেশি মিষ্টি থাকে।ধীরে ধীরে রসের পরিমাণ কমে আসলে আবার চাচ দেওয়া হয়। এভাবে কাটতে কাটতে কাছের মাথার কাটা অংশসিঁড়ির মত দেখতে হয়।প্রতিবছর এক পাশে কাটা হয় না। একবার এ পাশে পরের বছর ও পাশে।এ জন্য বড় খেজুর গাছের দু’পাশে ঢেউ তোলার মত থাকে। প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে ভাঁড় পাতা শুরু করেন আবার ভোর সকালেই সেই রস ভরা ভাঁড়গুলি পেড়ে আনেন গাছিরা।শীতআসলেই গাছিদের এই ব্যস্ততা বেড়ে যায়। শীতকালে গ্রামের এই দৃশ্যগুলোও বেশ মনোরম। খেজুর রসের এই ভালো লাগার ঐতিহ্য ছাড়াও খেজুরের রস প্রচুর খনিজ ওপুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। খেজুরের রস পান করলে শরীর সতেজ হয়ে ওঠে। ক্লান্তি দূর হয়।খেজুর রসকে প্রকৃতির এনার্জি ড্রিংক বলা হয়।এতে ১৫-২০% দ্রবীভূত শর্করা থাকে। এই রসে লৌহ বা আয়রন সুপ্ত অবস্থায় থাকে। রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করা হলে এতে আয়রন প্রচুর বেড়ে যায়। বাংলাদেশে খেজুর রস ও খেজুর গুড়ের পিঠা খাওয়া বেশ প্রচলিত তাই বিপুল জনগোষ্ঠীর মোটামুটি ১/৫ অংশ এই শীতকালে রক্ত স্বল্পতার হাত থেকে রক্ষা পায়। পেশির স্বাভাবিক কার্যকারিতা সচল রাখতে পটাসিয়াম ও সোডিয়াম বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে এবং ক্লান্তি দূর করতে ম্যাগনেশিয়াম যা খেজুরের রসে প্রচুর পরিমাণে থাকে। খেজুর রসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ক্যালসিয়াম। এটি হাড় ও পেশী গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। হাড়ের প্রধান উপাদান ক্যালসিয়াম এর অভাব দূর করে এই খেজুর রস।খেজুর রসে বিটামিন বি-৩ এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। যা জীবনী শক্তিকে সতেজ করে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে।রসের মিষ্টি অশোধিত চিনি। এটি ধীরে ধীরে রক্তে মিশে যায় ফলে দেহে চর্বি কম জমে। কিন্তু সাধারণচিনি দ্রুত রক্তে মেশে তাই চিনির খুব ভালো বিকল্প হতে পারে খেজুরের রস। প্রচুর ফাইবার বা আঁশ থাকায় এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে এবং এটি অনিদ্রা দূর করতেও সাহায্য করে।গুণে ও স্বাদে ভরপুর খেজুরস যে শুধু মানুষের পছন্দ তা নয়।মৌমাছি, বাঁদুড়,এমনকি সাপেও এ রস খায়।বাঁদুড়ের লালা থেকে নিপা ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বেশ কয়েক বছরআগে।তবে সতর্কতার সাথে রস সংগ্রহ করতে পারলে সে ভয় থাকে না। রসের হাড়ি বাঁধার সময় চারপাশে ভালোভাবে জ্বাল বেঁধে দেওয়া দেখা যায়।গাছিরা সাবধানতার সাথেই এখন রস সংগ্রহ করেন।প্রয়োজনে আরো সতর্কতা বাড়াতে হবে।েখেজুর রস কৃষির একটা অংশ।অধিকাংশ গাছিরাই এ সময়কে তাদের আয় রোজগারের একটা হিসেব রাখেন যা বছরের অন্য সময় থাকে না।এলাকা ভিত্তিক কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে গাছিদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যারমাধ্যমে নিরাপদ রস সংগ্রহ করা যেতে পারে। যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে কোনো বাঁদুড়, সাপ বা অন্য কোনো পোকামাকড় বসতে না পারে। খেজুর রসের মিষ্টি ঘ্রাণে ভরে উঠুক সবার প্রাণ, ম ম গন্ধ ছড়িয়ে পড়ুক গ্রাম থেকে শহরে।সবার জন্য খেজুর রস হোক নিরাপদ পানীয়।