জাকাত ইসলামের তৃতীয় খুঁটি-যা মানুষকে সহায়তা করে

কালের সংবাদ ডেস্কঃ লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগরঃ

জাকাত ইসলামের তৃতীয় খুঁটি। ইসলাম নামক ধর্মটি পাঁচটি স্হম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে । একজন মানুষ ইমান গ্রহণের পরপরই তার ওপর নামাজ ফরজ। নামাজের পরই কোরআনে জাকাতের কথা বলেছেন আল্লাহ তায়ালা। হাদিসেও সাওম ও হজের আগে জাকাতের কথা উল্লেখ রয়েছে।

ইমানদার নামাজি ব্যক্তির অলস বসে থাকার সুযোগ নেই। আগামী এক বছরে সে নিজে স্বাবলম্বী হবে এবং সমাজের দুস্থ-অসহায় মানুষকে স্বাবলম্বী করার ব্রত গ্রহণ করবে। সংক্ষেপে এই হলো জাকাতের মর্মকথা।

এবার শাস্ত্রীয় বিশ্লেষণ। মুজামুল ওয়াসিত প্রণেতার মতে, জাকাত শব্দের অর্থ ক্রমে বাড়তে থাকা ও পরিমাণে বেশি হওয়া, প্রবৃদ্ধি লাভ করা, পরিচ্ছন্ন হওয়া, পবিত্র ও শুদ্ধ হওয়া। বিখ্যাত আরবি অভিধান লিসানুল আরবের লেখক বলেন, ‘জাকাত অর্থ পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধ্যিক্য ও প্রশংসা। এ চারটি অর্থেই কোরআন ও হাদিসে জাকাত শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। ’ জাকাত শব্দের ভিতর দুটি অর্থ পাওয়া যায়।

একটি হচ্ছে অনবরত বাড়তে থাকা। আরেকটি হচ্ছে শুদ্ধ ও পবিত্র হওয়া। আরবি ভাষাবিজ্ঞানীরা বলছেন, যে জিনিস ক্রমে বাড়তে থাকে সে জিনিস অবশ্যই শুদ্ধ ও পবিত্র হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। যেমন আরবিতে বলা হয়, ‘জাকাজ জারউ ইয়াজকুজ জাকাহ’। অর্থাৎ কৃষির ফসল বেড়েছে, যেমনি করে প্রতি বছর বাড়তে থাকে।

কৃষির ফসল ক্রমে বাড়তে থাকবে তখনই যখন ফসল আবর্জনামুক্ত পরিচ্ছন্ন হয়। তাই জাকাত শব্দটির অর্থ ক্রমে বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি পবিত্র ও খাঁটি হওয়া। মন্দ কিছু যদি ক্রমে বাড়তে থাকে তাহলে সে ক্ষেত্রে জাকাত শব্দের প্রয়োগ সঠিক হবে না। যেমন আরবি রিবা শব্দের অর্থও বৃদ্ধি পাওয়া। কিন্তু এ বৃদ্ধির সঙ্গে পবিত্রতার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই সুদের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘রিবা’ ব্যবহার করা হয়েছে।
আল্লামা ইউসুফ কারজাভি (রহ.) তার বিখ্যাত ফিকহুজ জাকাত গ্রন্থে লিখেছেন, জাকাত শব্দটি যদি মানুষের গুণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় তাহলে অর্থ হবে সুস্থতা-সুসংবদ্ধতা। যেমন বলা হয়, ‘রজলুজ জাকা’। অর্থাৎ পবিত্র জাতির মধ্যে চরম মাত্রার কল্যাণকর ব্যক্তি। আবার বলা হয়, ‘জাকাল কাজিস শাহুদ’। অর্থাৎ সাক্ষ্য-প্রমাণে অধিকতর কল্যাণকর বিচারক।

জাকাতের এত অর্থ থাকা সত্ত্বেও শরিয়তের দৃষ্টিতে শব্দটি ধনসম্পদে আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট ফরজ অংশ বোঝানোর জন্য ব্যবহার হয়েছে। আর হকদারদের সে সম্পদ দেওয়ার প্রক্রিয়াকে জাকাত বলা হয়। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘ধনসম্পদ থেকে আল্লাহর নির্ধারিত সম্পদ বের করে দেওয়া জাকাত বলার কারণ হলো, এর বিনিময়ে সম্পদ ক্রমে বাড়তে থাকে আর জাকাতদাতা অনেক বিপদাপদ থেকে পবিত্র থাকে। ’ জাকাত মানুষকে দুই ধরনের বিপদ থেকে সুরক্ষা দেয়। প্রথমত, আখেরাতের জবাবদিহি থেকে। দ্বিতীয়ত, দুনিয়ার বালামুসিবত থেকে। এ কারণেই জাকাতের দ্বিতীয় অর্থ হলো পবিত্রতা বা শুদ্ধতা। অন্য একজন ইসলামি স্কলার লিখেছেন, ‘জাকাতের মাধ্যমে ব্যক্তি দুই ধরনের পবিত্রতা অর্জন করে। প্রথমত, সে তার সম্পদ পবিত্র করে। দ্বিতীয়ত, তার মনমনন কৃপণতা, স্বার্থপরতা, হিংসাবিদ্বেষ মুক্ত হয়ে যায়। ’ বিষয়টি ইমাম ইবনে তাইমিয়া আরও চমৎকার করে বলেছেন, ‘জাকাত দেওয়ার ফলে দাতার মন-আত্মা নির্মল-পবিত্র হওয়ার কারণে তার ধনসম্পদে আল্লাহ বরকত দেন এবং তা দিন দিন বাড়তে থাকে। ’ কারজাভি বলেন, ‘এ বৃদ্ধি কেবল ধনসম্পদে নয়, ব্যক্তির মনমানসিকতা, ধ্যানধারণায় প্রভাবিত হয়। ফলে জাকাতদাতা দিন দিন উন্নত রুচিরোধসম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠেন। ’ ইমাম নববি ‘আল-হাভি’ গ্রন্থপ্রণেতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘আরবি জাকাত শব্দটি ইসলামি শরিয়ত প্রবর্তনের আগেও বেশ পরিচিত ছিল। জাহেলি যুগের কাব্য ও কবিতায় এর ব্যবহার পাওয়া যায়। ’ তবে ইমাম দাউদ জাহেরি এ মতটি নাকচ করে বলেছেন, ‘ইসলামের আগে জাকাত শব্দের প্রচলন পাওয়া যায়নি। ’ (ফিকহুজ জাকাত)

 

Leave a Reply

Your email address will not be published.