জাতিসংঘ ৭৯তম অধিবেশন ও ইউনূস-বাইডেন বৈঠক

রায়হান আহমেদ তপাদার, লণ্ডন- লেখক, গবেষক ও কলামিষ্ট ঃ শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চেনা পরিবেশে নতুন পরিচয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন তিনি। দীর্ঘদিনের পরিচিতজনদের সামনে তুলে ধরবেন তার নতুন দায়িত্ব, নতুন বাংলাদেশকে। নিউইয়র্কে ড. ইউনূসের আগমন ঘিরে এখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বেশ উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠান নিয়ে বেশ আলোচনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ড. ইউনূস অত্যন্ত পরিচিত মুখ। তার সবচেয়ে বড় সুবিধা, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তাকে নতুন করে পরিচিত হতে হবে না এবং নতুন সরকারের বৈধতা নিয়ে কারও কাছে দেনদরবারও করতে হবে না। গত বছর শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জাতিসংঘের ৭৮তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেন, তার সঙ্গে এবারের কী পার্থক্য। হাসিনার বিদেশ সফর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে, সবসময় ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। কমপক্ষে ১৫০ জনের বিরাট লটবহর নিয়ে বিদেশ সফর করতে তিনি পছন্দ করতেন। এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও থাকতেন তার সমর্থকরা, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক-সবাই সরকারি খরচে। শেখ হাসিনা পনেরো বছর বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্রের উঁচুস্তরের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নেতাদের সঙ্গে খুব সোহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেননি। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের কোনো বৈঠক করতে তাকে দেখা যায়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আয়োজিত নৈশভোজে যোগ দিতে শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল অন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে।

গত বছর হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র সফরের দুটি নিজ উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমটি ছিল, পুতুলের নির্বাচনের জন্য সমর্থন আদায় করা এবং দ্বিতীয়টি ছিল, যুক্তরাষ্ট্রে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের কথিত তদন্ত নিয়ে যে সমস্যা হচ্ছে, তার একটা সুরাহা করা। ভারতীয় এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর সুপারিশে বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, সুলিভান জয়ের তদন্তের ব্যাপারে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করতে তার অপারগতার কথা জানান। হাসিনার এর আগের সফরগুলোতে জয়কে সবসময় দেখা যেত মুখ্য ভূমিকায়। কিন্ত গত বছরে জয়কে তার মায়ের পাশে একবারও দেখা যায়নি। যাইহোক, ২০২৪ সালের জাতিসংঘ অধিবেশনে ইউনূস যাচ্ছেন একটি ছোট্ট ডেলিগেশন নিয়ে। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এখন দিল্লিতে আশ্রয় নিয়েছেন। এক বছরের মধ্যেই কী পরিবর্তন! প্রেসিডেন্ট বাইডেনই ড.ইউনূসের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। বাইডেনের সঙ্গে যে ইউনূসের বৈঠক হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ড.ইউনূসের মিশনের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হচ্ছে: বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের বিপ্লবকে তুলে ধরা এবং নতুন সরকারের সংস্কার কাজগুলোর প্রতি সমর্থন আদায় করা, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন অব্যাহত রাখা, ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা এবং বাংলা দেশের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাহায্য ও সহযোগিতা চাওয়া। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা এবং শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ষে টানাপোড়েন চলছে, তার সমাধান করা সবচেয়ে কঠিন ও জরুরি।যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করার প্রস্তাব এড়িয়ে গেছেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্ক ছেড়ে যাবেন প্রধান উপদেষ্টা নিউইয়র্ক পৌঁছানোর আগেই। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি নিয়ে মোদি খুব নিশ্চিত নন। হাসিনার দিল্লি অবস্থানও একটা নাজুক বিষয়, এটি নিয়ে মোদি সরাসরি ইউনূসের সঙ্গে এসময় কথা বলতে চান না। তবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.এস জয়শঙ্করের মধ্যকার বাংলাদেশ-ভারত বৈঠক হবে এটি নিশ্চিত। এ বিষয়গুলো নিয়ে তাদের মাঝে কথা হবে। ড.ইউনূস নিউইয়র্কে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের এমন কোনো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নেই, যা নিয়ে আলোচনা করে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এবছর সাধারণ বিতর্কের প্রতিপাদ্য হলো-কাউকে পেছনে ফেলে নয়: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শান্তি, টেকসই উন্নয়ন ও মানবিক মর্যাদার অগ্রগতির জন্য একযোগে কাজ করা। বিশ্বব্যাপী আস্থার সংকট, বহুপাক্ষিকতা ও আলোচনার পথ উপেক্ষা করার ফলে সৃষ্ট সংকট থেকে সংঘাত, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির পাশাপাশি উদ্ভূত নানারকম বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নে কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপের অনুপস্থিতির প্রেক্ষাপটে এবারের প্রতিপাদ্যটি অত্যন্ত অর্থবহ। এবছরের অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এবছরই জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদরদপ্তরে বাংলাদেশ একটি উচ্চ-পর্যায়ের সংবর্ধনার আয়োজন করছে। এ সংবর্ধনায় বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদলের প্রধানদের পাশাপাশি জাতিসংঘের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিভিন্ন সংস্থা প্রধান অংশগ্রহণ করার কথা রয়েছে।

এ কথা বলার অবকাশ রাখে না যে, প্রধান উপদেষ্টার পরিচিতি এবং সুনাম বিশ্বব্যাপী। এ কারণে অনেকগুলো বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা তার সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও সভায় অংশগ্রহণের জন্যও অনুরোধ এসেছে। যেহেতু তিনি মাত্র তিনদিন নিউ ইয়র্কে অবস্থান করবেন, সেহেতু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এই স্বল্প সময়ের মধ্যে সবার অনুরোধ রক্ষা করা বেশ কঠিন। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্ক পর্বে বক্তব্য দেবেন। তিনি তার বক্তব্যে বিগত দুই মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অভাবনীয় গণঅভ্যুত্থানের বিবরণ ও আগামী দিনে জনভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও জনস্বার্থে নিবেদিত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় বিশ্ব-দরবারে তুলে ধরবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব, জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বিশ্বব্যাপী সংঘাত, রোহিঙ্গা সংকট, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিকূলতা, উন্নয়নশীল দেশসমূহ থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধ, নিরাপদ অভিবাসন, অভিবাসীদের মৌলিক পরিষেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তির টেকসই হস্তান্তর, এবং ফিলিস্তিন সম্পর্কিত বিষয়সমূহ তার বক্তব্যে উঠে আসতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা বেশ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। তিনি নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, নেপালের প্রধানমন্ত্রী, ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতিসংঘ মহাসচিব, জাতিসংঘ মানবাধিকার সম্পর্কিত হাইকমিশনার, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট এবং ইউএসএইডের প্রশাসকের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিয়ে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।

এছাড়াও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, ইতালির প্রেসিডেন্ট এবং কুয়েতের ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনের আলোচনা চলছে।এছাড়াও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতে পারেন বলে আশা করা হচ্ছে। এবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন।যা
গত তিন দশকে বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের সঙ্গে এমন বৈঠক কখনো হয়নি। নিউইয়র্কে অবস্থানকালে বাইডেনের পাশাপাশি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি, বাহরাইনের ক্রাউন প্রিন্স হামাদ বিন ঈসা আল খালিফা, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক শফ, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েনের সঙ্গে বৈঠক করবেন ড.ইউনূস। এ ছাড়া, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক, বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম খান, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক সামান্থা পাওয়ার, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। জাতিসংঘের অগ্রাধিকার ইস্যুগুলো প্রত্যেকটি আমাদের দেশের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই ইস্যুগুলোর উপর যে-সব ইভেন্ট আছে, বাংলাদেশ তার সব কয়টিতেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বহুপক্ষীয় কূটনীতিকে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে মনে করে। সার্বিক বিবেচনায় এবারের অধিবেশনে উপদেষ্টার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত ও সুদৃঢ় করবে এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.