শহিদুল ইসলাম জি এম মিঠন, সিনিয়র রিপোর্টারঃ নওগাঁর মহাদেবপুরে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস পালন উপলক্ষে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় ৫ জন জয়িতাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে।
এরা হলেন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি হওয়ায় উপজেলার খাজুর ইউনিয়নের কুঞ্জবন গ্রামের বুলবুল চৌধুরীর স্ত্রী ও সাংবাদিক মিজানুর রহমান মানিকের বোন জান্নাতুল ফেরদাউস লতা, শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করায় উপজেলা সদরের সাব রেজিস্ট্রি অফিস পাড়ার মরহুম সরদার মোকসেদ আহমেদের মেয়ে ও সোনালী ব্যাংক মহাদেবপুর শাখার ম্যানেজার মিজানুর রহমানের স্ত্রী,বকাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নাজনিন নাহার লায়লা, সফল জননী উপজেলা সদরের কলেজ পাড়ার আব্দুল লতিফ বাচ্চুর স্ত্রী নাজমা বেগম, নির্যাতনের বিভিষিকা মুছে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরু করায় ভীমপুর ইউনিয়নের হর্ষি গ্রামের কবির উদ্দিনের মেয়ে শাবানা বানু এবং সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় চেরাগপুর ইউনিয়নের শালবাড়ী গ্রামের ফয়েজ উদ্দিনের মেয়ে মনোয়ারা বেগম।
এ উপলক্ষে মহাদেবপুর উপজেলা প্রশাসন এর সহযোগিতায় উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর মানববন্ধন ও আলোচনা সভারও আয়োজন করে। সকাল ১১টায় উপজেলা পরিষদ চত্ত্বরে মানববন্ধন ও অডিটোরিয়ামে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা চেয়ারম্যান আহসান হাবীব ভোদন এতে প্রধান অতিথি ও সহকারি কমিশনার (ভূমি) রিফাত আরা বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুল হাসান সোহাগ এতে সভাপতিত্ব করেন। মহাদেবপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক আজাদুল ইসলাম আজাদ আলোচনা সভার সঞ্চালনা করেন। স্বাগত বক্তব্য দেন মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সুলতান হোসেন। এছাড়া অন্যদের মধ্যে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান অনুকুল চন্দ্র সাহা বুদু,মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রাবেয়া রহমান পলি, সমাজসেবা কর্মকর্তা রোকনুজ্জামান মন্ডল, জেলা আওয়ামী লীগের সসদ্য অজিত কুমার মন্ডল প্রমুখ এতে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি নির্বাচিত পাঁচজন জয়িতার হাতে ক্রেষ্ট ও সম্মাননা তুলে দেন। মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জানান, জয়িতা জান্নাতুল ফেরদাউস লতা প্রথম স্বামীর কাছ থেকে তালাকপ্রাপ্ত হয়ে মেয়েসহ অসহায় অবস্থায় থেকেও তার মেয়ে সন্তানকে মানুষ করেছেন, আর্থিক, সামাজিক, পারিবারিক নানা প্রতিবন্ধকতায় থেকেও নিজে উদ্যোক্তা হয়ে সেলাইয়ের কাজ করে আরো সাতজন নারী উদ্যোক্তা তৈরি করেছেন। ৭০ জন নারী শ্রমিক দিয়ে তিনি নকশি কাঁথা, শাড়ী, থ্রিপিস, ব্যাগ ও সকল ধরনের হাতের কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। মাত্র ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু করে সাত লক্ষ টাকা ব্যয়ে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। এখন তার মাসিক আয় ১৫ হাজার টাকা।
জয়িতা নাজনিন নাহার লায়লা উপজেলার বকাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। ছোটবেলা মা হারানো দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও নানা প্রতিকূলতা ও কুসংস্কারের মধ্যে থেকে নিজ উদ্যোগে পড়াশুনা চালিয়ে তিনি ইংরেজি বিষয়ে এমএ, বিএড ও এমএড ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি একজন সমাজ সংস্কারক ও হিতৈষি নারী। তার বিদ্যালয়ের শিশুদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে থাকেন। শিশুদের ঝরে পড়া রোধে তিনি অসামন্য অবদান রেখেছেন। গতবছর তিনি বিভাগীয় পর্যায়ে, ২০১৯ সালে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে এবং ২০১৭ সালে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা নির্বাচিত হন। এবছর তার বিদ্যালয় জেলা পর্যায়ে ও গতবছর উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ এসএমসি নির্বাচিত হয়। ২০১৭ সালে জাতীয় শিক্ষা পদক পুরস্কার প্রতিযোগিতায় তার বিদ্যালয় শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়, শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক, শ্রেষ্ঠ এসএমসি ও ঝরে পড়া রোধে শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় নির্বাচিত হয়। ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু ফুটবল টুর্নামেন্টে জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়।
জয়িতা নাজমা বেগম একজন সফল নারী। দরিদ্র অটোচালকের স্ত্রী হয়েও মেয়েকে মানুষ করেছেন। নিজে অষ্টম শ্রেণি পাশ হলেও তার মেয়ে উম্মে হাবীবা বর্ষা এখন পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজে তৃতীয় বর্ষে পড়াশুনা করছেন। বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে মানুষের সমালোচনার মুখেও নিজের বাড়িতে আত্ম কর্মসংস্থান মূলক কার্যক্রম চালিয়ে যান।
জয়িতা শাবানা বানু ২০১৬ সালে ১৪ বছর বয়সে বাল্য বিয়ের শিকার হন। পরের বছর তার স্বামী তাকে তালাক দেন। তার দরিদ্র পিতাও মারা যান। এ অবস্থা থেকে তার শিশু সন্তান নিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ান। নিজ উদ্যোগে লেখাপড়া চালিয়ে যান। বর্তমানে বিবিএ (অনার্স) চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সেলাই, হাতের কাজ, ব্লক বাটিকের কাজ করে মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন। নিজে উদ্যোক্তা হয়ে ৫০ জন নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন।
জয়িতা মনোয়ারা বেগম মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও দরিদ্র দিনমজুর স্বামীর ঘরে থেকে সকল বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে সমাজসেবা মূলক কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি আদিবাসী নারীদের, শিশুদের উন্নয়ন, সচেতনতা, বাল্যবিয়ে, নারী নির্যাতন রোধে অসামান্য অবদান রেখেছেন।