নানা প্রতিকুল পরিবেশের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি

মোহাম্মদ আককাস আলী : নানা প্রতিকুল পরিবেশের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃত আদিবাসীরা মূলত সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী হলেও এদের রয়েছে বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আদিবাসী সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এ অঞ্চলে বর্তমানে ওড়াও, সাঁওতাল, পাহান, ভুঁইয়া, মালো, মাহালী, রাজোয়ার, মুইশর প্রভৃতিসহ ৩৬টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করছে। তাদের সকলেরই রয়েছে নিজস্ব সভ্যতা ও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। অন্যভাবে বলতে গেলে মূলত এই আদিবাসীরাই প্রাচীন সংস্কৃতির ধারক-বাহক।
কিন্তু নানা কারণে আদিবাসী সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। টিকে থাকতে আধুনিক সংস্কৃতির সঙ্গে পাল্লা দেয়ার মতো যোগ্যতা ও ক্ষমতা এ দুটির কোনোটিরই সক্ষমতা তারা এখনো অর্জন করতে পারেনি। যার কারণে তাদের সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে এবং এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় বিলীন হয়ে যাবে আদিবাসী সভ্যতা ও সংস্কৃতি। এর জন্য তারা নিজেরাও কম দায়ী নয়। তাদের মধ্য থেকে যারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে তারা নিজেদের ঐতিহ্য রক্ষার কোনো চিন্তা না করে আদিবাসী ক্যাটাগরিতে রাখা নিজ নাম ও পদবির পরিবর্তন করে চলমান মূল ধারার সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। তারা অনেক সময় নিজেদের আদিবাসী বলে পরিচয় দিতেও সংকোচ বোধ করে।
উত্তরাঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীরা বছরের বিভিন্ন সময় সনাতন ধর্মের দুর্গাপূজা, কালীপূজা উদযাপনের পাশাপাশি বিভিন্ন নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক উৎসব পালন করে থাকে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কারাম পূজা, সহরাই পূজা, বাহা উৎসব, ফাগুয়া উৎসব, হাড়িয়ানী উৎসব, বানগাড়ি উৎসব ইত্যাদি।
 আদিবাসী নেতা দীপঙ্কর,যোগেশ জানান, ওড়াও সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের প্রধান উৎসব কারাম। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমাতে এ উৎসব পালন করা হয়। কারাম গাছের ডাল পূজার মাধ্যমে নেচে-গেয়ে আদিবাসী নারী-পুরুষরা এ উৎসব পালন করে। ফাগুনের পূর্ণিমা তিথিতে পালন করা হয় ফাগুয়া উৎসব। সাঁওতাল আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব সহরাই বা সারুল উৎসব। চৈত্র মাসে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা এ উৎসব পালনের মধ্যদিয়ে মৌসুমী ফল ভোগ করে।
এ ছাড়া আদিবাসী পল্লীতে ঘরে ধান তোলার পর হাড়িয়ানী পূজার মধ্যদিয়ে নবান্ন উৎসব পালন করে আসলেও বর্তমানে এসব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসবে ক্রমেই ভাটা পড়ছে। আগে আদিবাসীরা পৃথক পল্লীতে দলবদ্ধভাবে বসবাস করে সেখানে স্বাধীন মতো তাদের সংস্কৃতির চর্চা করতে পারলেও এখন তাদের পল্লী সন্নিকটে ব্যাপকভাবে অ-আদিবাসীদের বসতি গড়ে ওঠাসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক কারণে তারা আগের মতো আর এসব উৎসব পালন করতে পারছে না।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক গণেশ মার্ডি আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ক্রমেই হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে জানান, আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা ও রক্ষার জন্য প্রায় এক দশক আগে রাজশাহীতে সরকারিভাবে একটি কালচারাল একাডেমী গড়ে তুললেও প্রতিষ্ঠানটি আদিবাসীদের সংস্কৃতি চর্চা ও রক্ষায় তেমন কোনো ভুমিকা রাখতে পারেনি।
তিনি অভিযোগ করেন, এ কালচারাল একাডেমীতে আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি আদিবাসীদের সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে জোড়ালো ভুমিকা রাখতে পারছে না। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি বাংলাদেশকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। এই বৈচিত্র্যের অন্যতম অংশীদার উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠী। আদিবাসী সংস্কৃতি এ দেশ থেকে হারিয়ে গেলে বাংলাদেশ যে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় দেশ সেটি প্রমাণ করা অনেকটা কষ্টকর হবে। তাই বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশের সংস্কৃতির ঐতিহ্য রক্ষায় জাতীয় স্বার্থেই আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি চর্চা ও রক্ষায় উদ্যোগী হতে হবে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন আদিবাসী নেতৃবৃন্দ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.