বদলগাছীতে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি ১০ টাকার বিনিময়ে ভিজিএফ এর চাল তুলছেন শিশুরা

বুলবুল আহমেদ (বুলু),বদলগাছী(নওগাঁ): নওগাঁ বদলগাছী উপজেলা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে ৮-১২ বছরের শিশু। আগে দাঁড়ানোর জন্য হুড়োহুড়িও করছে তারা। তাদের হাতে আছে বস্তা। দেখে মনে হবে কিছু নেওয়ার জন্য। কিন্তু তারা নিজের জন্য না, অপরের জন্য চাল নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। একবার নিয়ে যেতে পারলে ১০ টাকা করে পাবে। এছাড়া সেখানে চাল কম দেওয়ারও অভিযোগ আছে। এমনই ঘটনা দেখা যায় নওগাঁর বদলগাছীতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিযেশ থেকে দেওয়া দরিদ্র মানুষের মাঝে ভিজিএফের চাল বিতরণে অনিয়ম উঠেছে উপজেলার বিলাসবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদে। গত ২৬ জুন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত উপজেলার বিলাশবাড়ি ইউনিয়নে ২২ শত ৮৫ জন কার্ডধারী দরিদ্র মানুষের মাঝে বিনামূল্যে ১০ কেজি চাল বিতরণ করা হয়েছে।

সরজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সরকার থেকে দরিদ্রদের জন্য দেওয়া ভিজিএফ এই চালগুলো ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন শিবপুর দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে বিতরণ করা হচ্ছে। শিশুরা হাতে করে চালের কার্ড নিয়ে এসে চাল নিয়ে যাচ্ছে। ওই এলাকার কিছু অসাধু ব্যবসায়ী শিশুদের হাতে ১০ টাকার বিনিময়ে একটি করে চালের কার্ড দিচ্ছে। শিশুরা চাল উঠিয়ে নিয়ে এসে অসাধু চাল ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। যে যতবার আনছে সে ততোবার ১০টাকা করে পাচ্ছে। ১০ টাকার বিনিময়ে ১০ কেজি চাল পাচ্ছে অসাধু চাল ব্যবসায়ী মহল। অবশ্য এর আগের রাতে ও সকালে ওই সকল কার্ড ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার বিনিময়ে কিনে নিয়েছে স্থানীয় চাল ব্যবসায়ীরা।

স্থানীয় আসল নাম উজ্জ্বল মন্ডল (সজল ছদ্মনাম) নামে এক ব্যক্তি বলেন, চাল বিতরণের আগের রাতেই ইউনিয়ন পরিষদের লোকজন ও দলীয় নেতা কর্মীরা কার্ড বিক্রয় করে দেন।

অবশ্য তার কথার সাথে মিল পাওয়া যায় স্থানীয় ইয়াকুব নামের এক ব্যবসায়ীর। তিনি জানালেন, আগের দিনেই কার্ডগুলো বিক্রি হয়ে গেছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। তিনি আরও বলেন, আমি এখন পর্যন্ত এক বস্তাও কিনতে পারিনি।

১০ বছরের (উজ্জ্বল ছদ্মনাম) নামের এক শিশু (আসল নাম মোরসালিন) ৯ বার চাল নিয়ে যাওয়ায় খুশি। আবারও কার্ড নিয়ে চাল নিতে এসেছে। কতো টাকা পেয়েছো জিজ্ঞেস করতেই বলে উঠলো একবারে দিবে। এরকম প্রায় অর্ধ শতাধিক শিশু চাল উঠানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তারা কেউ দুবার, কেউ তিনবার চাল নিয়ে যেতে পেরেছে। এমনকি লাইনে দাঁড়ানোর জন হুড়োহুড়ি পর্যন্ত করতে দেখা যায় তাদের। কারণ যতবার নিয়ে যেতে পারবে ততোবার টাকা পাবে তারা। আর এভাবেই কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা এইসব নি:স্পাপ শিশুদের ব্যবহার করছে। শামীম নামের ব্যবসায়ী পাঠিয়েছে বলে জানালো এক শিশু।

চাল ব্যবসায়ী শামীম ও গৌড়সহ চারজন একসাথে চাল কিনছে। তারা বলেন, এখানে মিনিমাম ২০ জনের মতো চাল কিনছে। আমরা চার জন মিলে কিনছি দুটো পয়সা কামাইয়ের জন্য। ভাই আপনার জন্য সমস্যা হচ্ছে। এখানে সবাই কিনছে, সবাই বিক্রি করছে। আপনি থাকলে চাল নিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছে।

বল্লামপুর গ্রামের সুফিয়াসহ দুইজন অসহায় নারী বলেন, যাদের ঘরে চাল আছে তাদেরকেই চাল দিয়েছে। আর আমাদের ঘরে চাল নেই আমরাই চাল পাই না। আমরা কার্র্ড ছাড়াই চাল নিতে এসেছি। যাদের কার্ড আছে তাদের দেওয়া শেষ হলে আমরা চাল নিবো। চেয়ারম্যানের কাছে গেলে তিনি যেটুকু পারেন চাল দিবেন।

তবে স্থানীয় অনেকে জানালেন, এই কার্ডগুলোর অনেক ভাগ হয়। চেয়ারম্যান, মেম্বার ও দলীয়ভাবে।

ইউনিয়নের এনামুল নামের স্থানীয় এক বাসীন্দাসহ অনেকে জানান, ১০ কেজি করে চাল দেওয়ার কথা থাকলেও পরিমানে ১ থেকে দেড় কেজি চাল কম দেওয়া হয়। কম দেওযার প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া অবশিষ্ট চাল যাদের কার্ড নেই তাদের মাঝে এই চাল ঠিকভাবে বিতরণ করা হয় কিনা সেটাও দেখার বিষয়।

৪০ বছরের এক যুবক চাল নিতে যাচ্ছে। তার হাতে আছে দুটো কার্ড। আরেক ভ্যানচালকের হাতে ১৪ টি কার্ড। সে সময় বুজে চাল নিতে যাবে। এভাবেই এই ইউনিয়নে ওপেন সিক্রেটভাবে গরীবের চাল যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের হাতে।

বিলাশবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান কেটু মুঠোফোনে কালবেলাকে বলেন, আমার ইউনিয়নে মোট ২২ শত ৮৫ জনকে এই কার্ড দেওয়া হয়েছে। এর বাহিরেও আরও কিছু দরিদ্র মানুষদের চাল দেওয়া হয়ে থাকে। কোনো কারণে যদি চাল অবশিষ্ট থাকে সেক্ষেত্রে তাদেরকে দেওয়া যায়। শিশুরা ১০ টাকার বিনিময়ে কার্ড নিয়ে গিয়ে চাল উঠাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি নিজে হাতে সর্ব্বোচ্চ দুই শত কার্ড বিতরণ করতে পেরেছি। আমি যদি সকল কার্ড নিজে বিতরণ করতে পারতাম তাহলে মনে হয় ব্যবসায়ীরা চাল কেনার এই সুযোগ পেতনা। আমার পক্ষে নিজে গিয়ে ২২ শত ৮৫ জন মানুষের মাঝে কার্ড বিতরণ করা সম্ভব না। এরমধ্যে অর্ধেক কার্ড আমি চোখে দেখতে পারিনা। বাকি কার্ড মেম্বারসহ অন্যরা মিলে বিতরণ করা হয়েছে। যাদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে তাদের মধ্যে হয়তোবা কিছু লোক টাকার বিনিময়ে কার্ডগুলো ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রয় করেছে। তবে শিশুদের দিয়ে এই কাজ করানো ঠিক না। আমি পরবর্তীতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।

শিশুদের ব্যবহার করে ব্যবসায়ীরা চাল কিনছে এবিষয়ে জানতে চাইলে বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলপনা ইয়াসমিন মুঠোফোনে কালবেলাকে বলেন, যাদের কার্ড দিয়ে ব্যবসায়ীরা এই চাল উঠাচ্ছে তাদের নাম দিলে আমি কার্ড বাতিল করবো। উপস্থিত ট্যাগ অফিসারকে বিষয়টি তিনি জানাতে বলেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.