বৈষম্য কমিয়ে সুষম পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ জরুরি

রায়হান আহমেদ তপাদার-ইংল্যান্ড-লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট : গত আড়াই দশকের উল্লম্ফিত এবং ত্বরান্বিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সমাজে বৈষম্য বেড়েছে বহুগুণ। অথচ একটি ন্যায়সংগত সমাজ বিনির্মাণ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৈষম্যকে উসকে দেয় কথাটি সত্যি, তাই বলে তা সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি হলে সমাজে অস্থিতিশীলতা অবশ্যম্ভাবী এবং অবশ্যম্ভাবী অস্থিতিশীলতা নিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনো টেকসই হয় না। বৈষম্যের কারণে শুধু যে ব্যক্তি বঞ্চিত হয় তা নয়, পুরো অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্নীতির দাপট দেশের ভেতর হেড টু ফুট; এমন সরকারি দপ্তর নেই, যেখানে অবৈধ অর্থের সংযোগ নেই। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে উন্নয়ন আর দুর্নীতি সমার্থক হয়ে ধরা দিচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।সমাজের অনগ্রসর ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে একটি দেশের সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রণয়ন করে। এ কর্মসূচির আওতায় সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগণের দারিদ্র্যমোচন, মানবাধিকার, সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা হয়। অর্থাৎ এটি সমাজে বৈষম্য কমিয়ে সুষম পরিবেশ তৈরির একটি উদ্যোগ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেশে যাদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় থাকার কথা, তাদের অনেকেই বঞ্চিত রয়ে গেছেন। প্রকৃত উপকারভোগী বাছাই ও এ কর্মসূচির দ্বারা প্রাপ্ত সুফলের ন্যায্য বণ্টন সবার কাছে পৌঁছানো যায়নি। সময়ের পরিক্রমায় এর পরিসর বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু টেকসইভাবে দারিদ্র্য বিমোচনে এ কর্মসূচির প্রভাব সেভাবে দেখা যায় না। বৈষম্য ও অধিকার শীর্ষক এক জাতীয় সংলাপে একাধিক বক্তা এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন এবং নানা চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেন। তারা জোর দিয়ে বলেন, জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ এ খাতে ব্যয় হলেও কর্মসূচিগুলোর প্রকৃত প্রভাব প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম।

এছাড়া তারা বিদ্যমান বৈষম্য কমিয়ে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিসর বাড়ানোর কথাও বলেছেন। দেশে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির প্রকৃত প্রভাব নিশ্চিতের পথে প্রধান অন্তরায় হলো প্রকৃত চাহিদাসম্পন্নরা এটির আওতায় নেই। অর্থাৎ উপকারভোগীর তালিকা তৈরির প্রক্রিয়াটিই স্বচ্ছ নয়। একই সঙ্গে বিতরণ প্রক্রিয়াও দুর্নীতিগ্রস্ত। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের এক মধ্যবর্তী উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির তালিকাভুক্ত ভাতাভোগী- দের ৪৬ শতাংশ ভাতা পাওয়ার যোগ্য নয়। এ পরিসংখ্যান থেকেও এটিই প্রতীয়মান হয় যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ উপকারভোগী নির্বাচন। উপকারভোগী নির্বাচনের দায়িত্বে থাকেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। তারা ভোট, ভোটারের চিন্তা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ইত্যাদি মাথায় রেখে তালিকা তৈরি করেন। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি এ বাছাই প্রক্রিয়াকে কলুষিত করে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। এতে অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যক্তিরা তালিকাভুক্তি থেকে বাদ পড়েন, যার ফলে তারা কর্মসূচির সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন। এতে দারিদ্র্য হার হ্রাসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আবার সামাজিক সুরক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে বরাদ্দকৃত অর্থেরও অপচয় হয়। উপকৃত হয় শুধু ক্ষমতার আনুকূল্য গ্রহণকারীরা। এ পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে প্রকৃত উপকারভোগীর সংখ্যা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বিধান অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি সুবিধাগুলোর ন্যায্য বণ্টনও নিশ্চিত করতে হবে। এতে আশা করা যায়, স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক নিরাপত্তা জালের বিস্তার ঘটবে। ২০১৫ সালে জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশল (এনএসএসএস) গৃহীত হয়।এই প্রবর্তনের নয় বছর পরও বিপুলসংখ্যক লোক এ কর্মসূচির আওতায় আসেনি।

এনএসএসএস উদ্যোগ সফল করতে হলে এক্ষেত্রে বিদ্যমান দুর্নীতি, অনিয়ম ও বৈষম্য দূর করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় গৃহীত প্রকল্প গুলোর তদারকি জোরদার করতে হবে। এ ছাড়া নির্দিষ্ট সময় অন্তর উপকারভোগীদের অবস্থার মূল্যায়ন এবং মূল্যায়ন সাপেক্ষ পরবর্তী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত। বাস্তবে কত শতাংশ অভাবী মানুষের জীবনযাপন মানের উন্নয়ন হলো তার হিসাব রাখতে হবে।সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাজেটস্বল্পতাও একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে প্রতি বছর ১০ শতাংশ করে উপকারভোগী বাড়ানোর কথা থাকলেও বাস্তবে তা সম্ভব হয় না। চলতি অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেটিও অপ্রতুল। ‍বিশেষ করে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বরাদ্দ একেবারেই কম দেয়া হয়েছে। পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ ও কৃষি ভর্তুকি ইত্যাদি গণনায় এনে এ খাতের বরাদ্দ স্ফীতভাবে দেখানো হয়েছে। সুতরাং বরাদ্দ বাড়ানোও আবশ্যক। বাজেট যখন প্রণীত হয়েছিল, সেই সরকার এখন দায়িত্বে নেই। রাজনৈতিক পালাবদলের মুখে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তাদের উচিত এ খাতের বরাদ্দ পুনর্মূল্যায়ন করে সংস্কার আনা এবং বিতরণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।সরকারের সুযোগ-সুবিধা যাতে একজন দরিদ্র সরাসরি পেতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনো মধ্যস্বত্বভোগী সুযোগ নিতে না পারে। এক্ষেত্রে সুরক্ষা কর্মসূচির সেবাগুলোর ডিজিটালাইজেশন করার দিকে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে কর্মসূচিগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের মধ্যে যেন সমন্বয় থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় থাকা দরিদ্র সব মানুষকে ডাটাবেজে আনা তৎকালীন সরকারের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।

বর্তমান পরিস্থিতিতে যাচাই-বাছাই করে উপকার ভোগীদের ডাটাবেজ তৈরিতে সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচনে তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। এ কর্মসূচি থেকে প্রাপ্ত সুফলকে কীভাবে দীর্ঘমেয়াদে কাজে লাগানো যায় তা জনগণকেই ঠিক করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার শহর ও গ্রামের দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারা সমুন্নত রাখার চেষ্টা করে। তবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নাম ভাঙিয়ে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ যখন অন্যরা নিয়ে যায়, এতে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে ওঠে। তাই নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রাপ্য অধিকারের জন্য দরিদ্র জনগণদের সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, অর্থনীতিতে এখন তিনটি সমস্যা আছে বলে বিজ্ঞজনদের ধারণা। এগুলো হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা ও আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা। নতুন সরকার এসে সামষ্টিক অর্থনীতির যেসব সূচকে নজর দিতে হবে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি ও প্রবাস আয়, ব্যাংক খাত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিদেশি ঋণ, রাজস্ব আয় ইত্যাদি। নতুন বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ে বড় চিন্তায় থাকতে হবে নীতি নির্ধারকদের। কারণ পরিসংখ্যান বলছে, মূল্যস্ফীতি কিছুতেই ৯ শতাংশের নিচে নামছে না। বাজারেও ভোগ্য পণ্যের দাম খুব একটা কমেনি। গত মার্চ থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। আর চার মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত আধুনিক
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাবারের ক্রমবর্ধমান দাম দেশের ৭১ শতাংশ পরিবারের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশে এখন মোট পরিবার বা খানার সংখ্যা চার কোটি ১০ লাখ।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব মানলে, খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা দুই কোটি ৯০ লাখের বেশি পরিবারের জন্য উদ্বেগের বিষয়। অতএব মূল্যস্ফীতির চাপে নাকাল বিশেষত দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া আশু কর্তব্য নতুন সরকারের। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য টেকসইভাবে দারিদ্র্য বিমোচন করা। তাই এ কর্মসূচির সেবাগুলো চরম দরিদ্রদের কাছে পৌঁছে দেয়া জরুরি। যারা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকে তারা স্বাভাবিক ভাবেই সামাজিক কার্যক্রম ও পরিষেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। কেননা তাদের অনেকেরই ব্যাংক হিসাব,স্থায়ী ঠিকানা কিংবা আনুষ্ঠানিক পরিচয়পত্র নেই। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও অনেক সময় তারা সামাজিক ভাবে হেয়প্রতিপন্ন হয়ে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার ও অংশীজনদের এমন নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত, যার মাধ্যমে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্তির বাধাগুলো দূর হবে, অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গৃহীত হবে এবং দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে ভুক্তভোগীদের বের করা সম্ভব হবে। তাই যথাযথ সুশাসন নিশ্চিত করে দুর্নীতি দূরীকরণ ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্য হ্রাস বর্তমান নির্বাচিত সরকারের অগ্রাধিকার থাকবে বলে দেশের প্রতিটি মানুষ প্রত্যাশা করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.