স্বাগতম ও অভিনন্দন ড.ইউনুস এবং আরও যারা

রায়হান আহমেদ তপাদার,ইংল্যান্ড -লেখক, গবেষক ও কলামিষ্ট ঃ বাংলাদেশের ইতিহাস যেমন সুদীর্ঘ, তেমনি বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসও অনেক লম্বা; যার কোথাও রক্তস্নাত স্মৃতি, আবার কোথাও বিজয়গাথা। ইতিহাস দিয়েই বাংলাদেশ রচিত হয়েছে।আন্দোলন- সংগ্রাম এ দেশের জনগণের শিরায় শিরায় বহমান। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। স্বাধীন দেশে যতবার কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকের আবির্ভাব হয়েছে, ততবারই সেই সরকারের পতন নিশ্চিত করেছে জনতা গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে। ইতিহাস প্রতিটি গণ-অভ্যুত্থানের জয়গাথা লিখে রেখেছে। ব্যতিক্রম হলো না এবারো। ৫ আগষ্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কর্তৃক গৃহীত কর্মসূচি ‘মার্চ টু ঢাকা’ পালনে কারফিউ ভঙ্গ করে সর্বস্তরের মানুষ ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে। এর মধ্যে দেশের ক্ষমতাসীন সরকার তীব্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে। বাংলাদেশ সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সেই সরকারের মাধ্যমেই দেশ পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন। এছাড়া তিনি সব হত্যা ও অন্যায়ের বিচারের অঙ্গীকার করে সেনাবাহিনীর প্রতি সবাইকে আস্থা রাখার অনুরোধ করেন। একই সঙ্গে তিনি সবাইকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থান সফল হওয়ায় বর্তমানে দেশজুড়ে যতটা উল্লাস, অস্বীকার করার অবকাশ নেই যে ততটা উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার সম্মুখেও দাঁড়িয়ে আছে দেশ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনার দাবি রাখে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৭ অনুযায়ী পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত পদত্যাগী সরকার দায়িত্ব চালিয়ে নেয়। গণ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সেই ধারাবাহিকতা সম্ভব নয়।

গত ছয় আগস্ট রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। আন্দোলনকারী ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড.ইউনূসকে প্রধান করে দেশের পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৬ আগষ্ট বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানেরা ও ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ড. ইউনূস ছিলেন শিক্ষকতা পেশায়। সেখান থেকে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। পরে ওই ব্যাংককে সাথে নিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেই থেকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বেও সুনাম কুড়িয়েছিলেন অধ্যাপক ইউনূস। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আরও যারা রয়েছেন তারা হলেন: সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ড.আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান খান, হাসান আরিফ, তৌহিদ হোসেন, সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান, মো. নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন, সুপ্রদিপ চাকমা, ফরিদা আখতার, বিধান রঞ্জন রায়, আ.ফ.ম খালিদ হাসান, নূর জাহান বেগম, শারমিন মুরশিদ এবং ফারুক-ই-আজম। তাঁরা সকলেই ৮ আগষ্ট ২০২৪ শপথ গ্রহণ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির পর বর্তমান সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রত্যক্ষ কোনো বিধান নেই। তবে একটি সফল আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের অধীন রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়োগ দিতে পারেন। অনুচ্ছেদ ৪৮ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধান। তিনি সংবিধান ও দেশের আইন প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর সরকার যেহেতু দায়িত্ব পালনের জন্য অনুপস্থিত, রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সর্বজনগ্রাহ্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে পারেন।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নবগঠিত সরকার সংসদীয় সরকারের আদলে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। রাষ্ট্রপতি ও নবগঠিত সরকারের প্রধানের বা প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শক্রমে তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। নতুন নির্বাচনের পর সংসদ গঠিত হলে যে সংসদ উপরিউক্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমকে বৈধতা দিয়ে অনুমোদন ও সমর্থন প্রদান করতে পারবে। একটি বিকল্প পন্থা হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন করা যেতে পারে। জরুরি ভিত্তিতে শুনানি করা হলে আপিল বিভাগ রায়টি বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। তারপর সংবিধান অনুযায়ী একটি সর্বজনগ্রাহ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। যে পন্থাই গ্রহণ করা হোক না কেন, প্রবর্তিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে একটি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। রাষ্ট্রপতির আদেশে সংবিধানের ওপরে বর্ণিত বিধানগুলোর উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। জনগণই সব ক্ষমতার উত্স এবং তাদের ইচ্ছার প্রতিফলনরূপে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। চলমান ক্রান্তিকালে রাষ্ট্র-শৃঙ্খলা ফেরানো, জননীতিতে স্বচ্ছতা আনয়ন এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে দরকারি সংস্কার আনতে হবে। বসে থাকার সময় নেই। সত্যিকার অর্থেই এই দরকারি কাজের তালিকা অতি দীর্ঘ। এর মধ্যে যে কাজগুলোতে এখনই মনোযোগ দিতে হবে, যেমন: স্টেকহোল্ডার হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পর্যাপ্ত আলোচনা সাপেক্ষে অতিদ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে হবে। আয়নাঘর থেকে শুরু করে রাজবন্দীদের মুক্তির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতই এই মুহূর্তের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বিবেচনা করতে হবে।

রাষ্ট্র সংস্কারে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি গুরুত্ব পাবে। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস, সচিবালয়ের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, সব সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান প্রধানের ক্ষমতা বাড়ানো, সংসদ-বিচার বিভাগ-আমলা তন্ত্রে ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। বিচার বিভাগে অতিদ্রুত আওয়ামী নৈরাজ্য এবং দলীয়করণ বন্ধে দেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ডজন ডজন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, যেখানে কম ক্ষমতার প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় আর নাক গলাতে পারবে না। দেশে এমন সংবিধান সংস্কার দরকার, যাতে আইনি কাঠামোতে আর কোনো প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচার না হয়ে ওঠে। এই ভিশন বাস্তবায়নের স্বল্প মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি অনুষঙ্গ আছে। তবে তাৎক্ষণিক গুরুদায়িত্ব হচ্ছে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা। ব্যাংকিং সুশাসন ও পরিচালনা নৈরাজ্য বন্ধ,খেলাপি ঋণ ফেরানো, পাচার বন্ধ, রাজস্ব লিক থামানো, পরিসংখ্যান জালিয়াতি শুধরানো, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি ফেরাতে আলাদাভাবে জাতীয় টাস্কফোর্স তৈরি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি এলসি কোয়ালিটি নির্ধারণে এক্সপার্টদের নিয়ে দ্রুত টাস্কফোর্স করতে হবে এবং মুদ্রানীতি রিভিউ করতে হবে। এখানে আমলাদের গুরুত্ব না দিয়ে সাবজেক্ট ম্যাটার এক্সপার্টদের খুঁজে বের করতে হবে। রাষ্ট্রের সব ধরনের নজরদারির মেকানিজম রিভিউ করা দরকার। সফিস্টিকেটেড এসব সিস্টেমে দেশ-বিদেশের কাদের অ্যাকসেস আছে, সেসব দ্রুত ফরেনসিক না করা হলে সরকারের যোগাযোগ অনিরাপদ থেকে যাবে। এতে সরকারে অস্থিতিশীলতা তৈরির সুযোগ থেকে যাবে। ইন্টারনেট ও টেলিকম খাত মনিটরিং, এনটিএমসি এবং ল-ফুল ইন্টারসেপ্টের মেকানিজমকে অডিট এবং মনিটরিংয়ের আওতায় আনা জরুরি।

ব্যবসায়ীদের প্যানিক না দিয়ে দ্রুত রাজনৈতিক ফান্ডিং, পাচার এবং ঋণখেলাপিবান্ধব শিল্পগোষ্ঠী ও ব্যবসায় প্রশাসক নিয়োগ করা দরকার। কোনো কোম্পানি যাতে ‘স্যাবোটাজ ফাইন্যান্স’ করতে না পারে। করপোরেট খাতের রাজস্ব লিকেজ নিয়ে আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। পরিশেষে বলব, সাম্প্রতিক যে ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত হাসিনাকে পতনের দিকে নিয়ে গেল, তার শুরুটা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের একটি সাধারণ দাবি থেকে।কোটা আন্দোলনের শুরুটা খুব শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেখান থেকে সেটি অন্যান্য অভিজাত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে এবং তারপর তাতে সারা দেশে সাধারণ জনগণ জড়িয়ে পড়েন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তখন, যখন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা শুরু করেন। এটি একটি অরাজনৈতিক আন্দোলনকে বৃহত্তর বিদ্রোহে রূপান্তরিত করে। এই বিদ্রোহ মোকাবিলায় হাসিনার নেওয়া সব প্রতিরোধ ব্যর্থ হতে থাকে। গত মাসের শেষের দিকে ছাত্রদের দমন করতে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। এটি ব্যাপক সংখ্যক জনগণের ক্ষোভকে প্রজ্জ্বলিত করে। দেখামাত্র গুলির আদেশসহ কঠোর কারফিউ জারি আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করেছিল। শেখ হাসিনা বিক্ষোভকারীদের ‘রাজাকার’ হিসেবে তকমা দেওয়ায় তাঁদের উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়।বিক্ষোভের গতি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা তাঁদের অভিভাবক, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের সমর্থন পেয়ে যান। আন্দোলনটি যে দাবি নিয়ে শুরু হয়েছিল, সেটি শেষ পর্যন্ত হাসিনার পদত্যাগের দাবি হয়ে ওঠে।

একটি নায়কোচিত ও মহিমান্বিত আসন থেকে শেখ হাসিনার আকস্মিক পতন সেই সব নেতার জন্য একটি হুঁশিয়ারিমূলক দৃষ্টান্ত হতে পারে, যাঁরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নাগরিক স্বাধীনতার চেয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।আসাদের আত্মাহুতি, নূর হোসেনের গণতন্ত্রের জন্য গুলির সামনে বুক পেতে দেয়া থেকে রক্তাক্ত জুলাইয়ে আবু সাঈদ সিনা টান টান করে যেভাবে পুলিশের গুলি বুকে নিয়ে নিল তার মর্মার্থ কি বাঙালি বুঝতে পেরেছে? মানুষ হলে বুঝতে পারত কেন কখন টগবগে তরুণ সবকিছু ভুলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন সুন্দর দিনের জন্য বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেয়, আর যে বন্দুকের ট্রিগার টিপে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের বুক ঝাঁঝরা করে পুরো মানচিত্র রক্তে ভাসিয়ে দিল সে কবিগুরুর ভাষায় স্রেফ বাঙালি হয়ে থাকল, মানুষ হতে পারেনি। তবে এবার নোবেল বিজয়ী ড.ইউনুসের নেতৃত্বে আরও যারা দেশকে কোনদিকে এগিয়ে নিয়ে যান এটাই দেখার বিষয়। অভিনন্দন ও স্বাগতম ড.ইউনূস, ড.আসিফ নজরুল সহ ও আরও যারা রয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বে। তবে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন অগ্রযাত্রা কোন ক্রমেই যেন বিঘ্নিত না হয় এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.