এমপি সেলিমের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীনিতির অভিযোগ

এমদাদুল হক দুলু, বদলগাছী (নওগাঁ) প্রতিনিধিঃ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি সেচ্ছাচারিতার কারণেই কি নওগাঁ ৩-আসনের এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদার আওয়ামীলীগ থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পেলেন না? নৌকা থেকে ছিঁটকে পড়ায় জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচিত হয়ে হলো নৌকার মাঝি আবারও নৌকা থেকে এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদার ছিঁটকে পড়ায় অধিকাংশ আওয়ামীলীগ নেতা কর্মি আনন্দিত আবার মিষ্টি বিতরণ করেছে অনেকে। যে পথ দিয়ে তাঁর উত্থান আবার সেই পথ ধরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র থেকে নওগাঁ ৩-(বদলগাছী-মহাদেবপুর) আসনে প্রতিদন্দিতা করছেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় , ঠিকাদারী সিন্ডিকেট,খাস পুকুর ও জমি দখল, ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বানিজ্য, ও কমিটি বানিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্টানে নিয়োগ বানিজ্য, কমিশন আদায়, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বালুমহাল ইজারাদারসহ বিভিন্ন অনিয়মের সাথে জড়িত নওগাঁ-৩ ( মহাদেবপুর-বদলগাছী ) আসনের সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দীন তরফদার। ছায়া এমপি হিসাবে তাঁর এসব কাজের মূল হাতিয়ার তার ছেলে ও ভাগিনা। তিনি মহাদেবপুর সদরসহ বিভিন্ন স্থানে গড়েছেন বিপুল পরিমান সম্পদের পাহাড়। তার এসব সম্পদের মূল্য আনুমানিক কয়েকশ কোটি টাকা। এমন কর্মকান্ডে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা বিব্রত।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ সুত্র জানা যায়, ২০১৪সালে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে ছলিম উদ্দিন তরফদার স্বতন্ত্র থেকে নৌকার প্রার্থী সাবেক এমপি ড.আকরাম হোসেন চৌধুরীকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। এর পর থেকেই শুরু হয় তাঁর অস্বাভাবিক উত্থান। ২০১৮সালে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আবারও এমপি নির্বাচিত হন তিনি। বর্তমানে তিনি মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন। সেলিম এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তাঁর ছেলে রকি ও ভাগিনা শাকিলের বাহিনী এলাকায় শুরু করে দখলদারিত্ব। নামে-বেনামে শত শত বিঘা খাস পুকুর রয়েছে তাদের দখলে। রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে এসব পুকুরে মাছ চাষ করছেন তাদের লোকজন। প্রভাব খাটিয়ে অধিকাংশ স্কুল বিøডিং, রাস্তা-ঘাট, ড্রেন, বিভিন্ন ভবনসহ ঠিকাদারী কাজ তারাই করে থাকেন। এসব কাজে নি¤œমানের সামগ্রী ব্যবহার করে থাকেন নিয়মের কোন তোয়াক্কা না করেই। এসব নিয়ে ভয়ে কথার বলার সাহস পাইনা কেউ।

নির্বাচনী হলফনামা যা বলছে: নির্বাচনী হলফনায় নিজের পেশা ব্যবসা উল্লেখ করেছেন। তার ব্যবসা মূলত মৎসচাষ, বয়লার ও জোতদারী। সর্বশেষ ২০১৮সালের নির্বাচনে দেওয়া হলফনায় এমপি ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিম যে পরিমান সম্পদের বিবরণ দিয়েছিলেন, তা থেকে জানা যায়, নিজের নামে ২০.৯৮একর যার মূল্য ৬৩লাখ টাকা, স্ত্রীর নামে ৭ একর যার মূল্য ২৬লাখ টাকা এবং নির্ভরশীলদের নামে ১একর যার মূল্য ৬লাখ টাকা, অকৃষি জমির পরিমান দেখিয়েছিলেন ৬.১০একর যার মূল্য ২০লাখ টাকা, নিজ গ্রাম আজিপুরে পৈত্রিক বাড়ী ছাড়াও মহাদেবপুর সদরে একটি দালান বাড়ির মূল্য দেখানো হয়েছিল যার মূল্য ৩০লাখ টাকা। এছাড়া একটি পুকুরের মূল্য ৫৩লাখ টাকা দেখানো হয় এবং ব্যাংকে দায়-দেনার পরিমান দেখানো হয়েছিল কোটি ৭০লাখ টাকা। এমপি সেলিম তার ওই হলফনামায় পেশা হিসেবে দেখিয়েছিলেন চাউলকল ব্যবসা, মৎস্য ব্যবসা ও জোতদারী। এইসব খাতের মধ্যে কৃষি খাতে ১লাখ ৫০হাজার টাকা, বাড়ি,দোকান ও অন্যান্য ভাড়া ১লাখ ২০হাজার ,চাউল কল ব্যবসা ও মৎস্য খামার হতে ৩০লাখ, শেয়ার সঞ্চয় থেকে ২লাখ ৫০হাজার, অন্যান্য উৎস হতে (সংসদ সদস্য ভাতা) ৬লাখ ৬০হাজার এবং নির্ভরশীলদের ৭০হাজার টাকা বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন। এছাড়া অস্থাবর সম্পদ হিসেবে নগদ ২লাখ,ব্যাংকে জমা ২লাখ ৫০হাজার, একটি জীপ গাড়ির মূল্য ৫৫লাখ,গৃহ সামগ্রীর মূল্য বাবদ ৩লাখ ৫০হাজার, অন্যান্য ১লাখ ৭৫হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ এবং স্ত্রীর নগদ ৬০হাজার এবং ২৫ভরি স্বর্ণের গহনা বাবদ ১২লাখ টাকার হিসেব দেখানো হয়। সর্বশেষ ২০১৮সালে এমপি সেলিম রিটানিং অফিসারের কাছে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী জমা দেয়। ওই সময় আয়কর বিভাগে দাখিলকৃত অর্থবছরের আয়কর ফাইলের বিবরণীও সংযুক্ত করেন। এতে দেখা যায় ২০১৪সাল থেকে ২০১৮সাল পর্যন্ত ৫বছরে তার সম্পদ বেড়েছে প্রায় ৪০গুন।

লাগামহীন সম্পদের মালিক: ২০১৪সালে এমপি হওয়ার পর নওগাঁ শহরের গোস্তহাটির মোড়ে প্রায় ৮০কোটি টাকা ব্যায়ে ৩১ শতক জায়গার উপর একটি ১২তলা টাইম স্কয়ার নামে বানিজ্যিক ও আবাসিক ভবন রয়েছে। মহাদেবপুর সদরের কলেজ রোডে এক কোটির অধিক টাকা দিয়ে ৩তলা বাড়ি কিনেছেন। বর্তমানে এটি ৫তলা ভবন। যার নাম নক্ষত্র বাড়ি নামেই পরিচিত। গ্রামের বাড়িতে রয়েছে বিশাল গরুর খামার ও একটি ইট ভাটা, বদলগাছী, রাজশাহী শহর ও ঢাকাতে রয়েছে একাধিক জমি,মার্কেট, অ্যাপার্টমেন্ট ও বাড়ি রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। মহাদেবপুর সাব সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে পাওয়া সূত্রে ২০১৪সাল থেকে ২০২২সালের সেপ্টম্বর পর্যন্ত এমপি সেলিম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ৮২টি জমি ক্রয় করার দলিল পাওয়া যায়। সেসব দলিলের মূল্য ৮ কোটি ৫২টাকা ১৭হাজার টাকা। রয়েছে একাধিক গাড়ি, নিজের ও পরিবারের সদস্যদের ব্যাংকে একাউন্টে রয়েছে কোটি কোটি টাকা।

যত অভিযোগ এমপি সেলিম, তার ছেলে ও ভাগিনার বিরুদ্ধে: অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি মহাদেবপুর সদর, উত্তরগ্রাম ইউনিয়ন, ভীমপুর ইউনিয়ন এবং এনায়েতপুর ইউনিয়ন এর বিএনপির ১৫জন নেতা-কর্মীকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগি সংগঠনের নানা পদে যুক্ত করেছেন। মহাদেবপুর থানা বিএনপি তালিকা থেকে এসব তথ্য জানা যায়। সম্প্রতি বদলগাছী কোলা আদর্শ ডিগ্রী কলেজে তিনজন প্রভাষক ও একজন ল্যাব সহাকারী পদে মোট ৮৮লাখ টাকা নিয়োগ বানিজ্যর অভিযোগ উঠেছে। এই টাকাগুলো এমপি সেলিম তার নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন বলে অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ধৈনজৈল চেরাগপুর ইউনিয়ন সমবায় সমিতির ১৫শতাংশ জায়গা দখল, রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে মাইবার দিঘীর ৪২ বিঘা জমি দখল এবং তার পাশেই অবস্থিত আদিবাসী পাড়ার ২৫বিঘা জমি দখল করে পুকুর খনন,আলতাদিঘী,রাইগাঁ ইউনিয়ন এর কৃষœপুর মৌজায় ৪২বিঘা জমি দখলের অভিযোগ করা হয়েছে চিঠিতে। এ ঘটনার পর এমপি সেলিমের বিরুদ্ধে ১৫স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে মহাদেবপুরের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কাজী নুরুজ্জামান বেলাল, বদলগাছী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য শহিদুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্টানে নিয়োগ বানিজ্য, ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বানিজ্য, দলীয় পদে নিয়োগ বানিজ্য ও স্বজনপ্রীতি মাধ্যমে পারিবারিক সামরাজ্যবাদ গড়ে তোলেন বর্তমান এমপি। নামে বেনামে অঢেল সম্পদের পাহার গড়ে তুলেছেন তিনি। ত্যাগি নেতাদের মূল্যায়ন না করে নিজের পছন্দমত কমিটি করে বিভিন্ন পদে বিএনপি জামায়াত সমর্থিত নেতা কর্মীদের স্থান দিয়েছেন। নিয়োগ বানিজ্য, জমি,খাস পুকুর দখলসহ বেশ কিছু অভিযোগ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবার অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।
মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ময়নুল ইসলাম বলেন, আমি সফাপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ২০১৬সাল এবং ২০২১সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলাম। এমপি সেলিম তার পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে আমাকে হারিয়ে দেয়। দলীয় নীতি আদর্শের তোয়াক্কা করেননা তিনি। আমাকে নাকি উপজেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক নাকি করা হয়েছে। দুই বার চিঠি দিয়েছিল। তার পর আর কোন চিঠি দেইনি। তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটিই প্রকাশ করেনি। আপনারা যা তথ্য পেয়েছেন তার চেয়ে অধিক সম্পদের মালিক তিনি। দুই উপজেলার শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্টানগুলোতে বিভিন্ন পদে নিয়োগে ১৫ -২০লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ হয় এসব নিয়োগের সিংগভাগ টাকা তার পকেটে যায়। শুধু এলাকাতে নয় দেশের বিভিন্ন স্থানে এমনকি দেশের বাহিরেও তার সম্পদ আছে। আমাদের জানামতে তার ৮টি গাড়িও আছে। স্থানীয় ইউপি নির্বাচনে বিপুল অর্থের নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া, দলীয় পদ দিয়ে অর্থ আদায়, কিছু নেতা-কর্মীদের ব্যবহার করে খাস জমি ও পুকুর দখলে রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে কয়েকজন ঠিকাদার বলেন, মহাদেবপুর ও বদলগাছীর বিভিন্ন দপ্তরের অধিকাংশ কাজই এমপি সাহেবের ছেলে ও ভাগিনা পায়। আমরা তেমন কোন কাজ পাইনা। আবার কিছু কাজ পেলেও কমিশন দিতে হয়। সবই বুঝতে পারছেন কেন এমনটা হয়। এর বেশি কিছু বলতে চাইনা। পরে সমস্যা হতে পারে আমাদের। মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে অভিযোগগুলো সব মিথ্যা বলে এমপি ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিম এই প্রতিবেদককে বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্টানে নিয়োগ এর বিষয়গুলো থাকে কমিটির উপর। আমার জানার বিষয় না। আমার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ দিতেই পারেন কিন্তু সেগুলো কতটা সত্য সেটাই দেখার বিষয়। আর নওগাঁ শহরের যে বাসা, ৩১শতক জমি যেটা ১৯৮৯সালে ক্রয় করা।

তিনি আরও বলেন, আমি ১০ বছর এমপি ছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনা ও সার্বিক সহযোগিতায় আমার নির্বাচনী এলাকায় যে উন্নয়ন করেছি অতীতে এর একাংশ ও হয়নি। আমি সবার পাশে থেকেছি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমি নৌকা পাইনি। দলের সভাপতি পরোক্ষভাবে নির্দেশনা দিয়েছে স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করার। আমি স্বতন্ত্র থেকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি। আমি এলাকার অনেক উন্নয়ন করেছি, অনেক কিছু দিয়েছি। এখন পরীক্ষার পালা। এলাকাবাসী আমাকে কি দিবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.