১৯৭১সালে উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় মুক্তিযুদ্ধ ও বীরত্বের কাহিনী 

এমদাদুল হক দুলু বদলগাছী (নওগাঁ) প্রতিনিধিঃ নওগাঁ জেলা সদর থেকে বদলগাছী উপজেলার ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের দূরুত্ব ২৯.৫ কিঃ মিঃ।  ঐতিহাসিক পাহাড়পুরেই ১৯৭১ সালের ৭ অক্টোবর দুপুর ১২.১০ মিনিটে ২৫ জন খানসেনা ও রাজাকার বাহিনী পাহাড়পুরে প্রবেশ করে। পূর্ব ১৩ নং ফরমজুল হক পান্না পার্টি (মুক্তিযোদ্ধা) পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের আশেপাশে এ্যাম্বুশ করেছিল। পাক সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের এ্যাম্বুশের আওতায় এলে এল.এম.জি, এস.এল.আর ও থ্রিরাইফেল এক সঙ্গে গর্জে উঠে। এতে তারা বেশ কিছু ধরাশায়ী হয় আর কিছু পাক সেনা পালিয়ে জয়পুরহাট কাম্পে যায়। কিছুক্ষনের মধ্যে ৩০০ খান সেনা ও রাজাকার বাহিনী অটোমেটিক অস্ত্রস্বত্রে সজ্জিত হয়ে পুনরায় পাহাড়পুর গ্রাম ঘিরে ফেলে।

মুক্তিযোদ্ধারা তখন পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার রেষ্ট হাউজের আশেপাশে এ্যাম্বুশরত ছিল। এসময় মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে পাক বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিবাহিনীর চারটি এল.এম.জি , ছয়টি এস.এল.আর ও ২০ রাইফেল আবারও এক সঙ্গে গর্জে উঠে। এক ঘন্টার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর গুলি শেষ হওয়ায় পাকবাহিনী রাজাকার ও দালালের সহযোগিতায় পেছন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় আফজাল, শরিফ, আসির উদ্দীন ও গণি ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর করিমের এল.এম.জির গুলি শেষ হওয়ায় সে আতœগোপনের চেষ্টাকালে পাক সেনারা তাকে পিছু থেকে ধরে ফেলে। শহীদ আফজাল হোসেন জয়পুরহাট কলেজের মানবিক শাখার ছাত্র ছিল।

 তার নিবাস নওগাঁ জেলার বদলগাছী থানার উত্তর রামপুর গ্রামে পিতা মোঃ আজিজ সরকার। চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে সে শহীদ হয়। তাকে তার গ্রামের বাড়িতে সমাধিস্থ করা হয়। শরীফ উদ্দীন ছিলেন মুক্তিবাহিনীর এক জন গ্রæপ লিডার। তার বাড়ী বগুড়া জেলার আদমদিঘী থানার শিবপুর গ্রামে। তিনি পুলিশের চাকুরী করতেন পিতা মোঃ ছমির উদ্দীন মোল্লার এক মাত্র সন্তান ছিলেন। তার এল.এম.জি-র গুলি শেষ হওয়ায় চিৎকার দিয়ে সঙ্গীদের নিকট হতে গুলি চাইছিল।

এসময় খান সেনাদের গুলি এসে তার বুকে বিদ্ধ হলে তিনি ঘটনা স্থলেই শহীদ হন। তাকে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার জাদুঘরের দক্ষিন পার্শ্বে সমাধিস্থ করা হয়। মোঃ ফরিদ উদ্দীন কুষ্টিয়া জেলার থানা পাড়া গ্রামের (দর্শনা) অধিবাসী। পিতা জনাব কিসমত উদ্দীন মল্লিক ছিলেন একজন ষ্টেশন মাষ্টার। শহীদ ফরিদ উদ্দীন রাজশাহী জেলার বদলগাছী থানার পি.এল.এ ছিলেন। তার নিকট থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও ১০০ রাউন্ড গুলি ছিল। গুলি শেষ হওয়ার পর পাক সেনারা তাকে জ্যান্ত ধরার জন্য তার উপর লাফিয়ে পরে।  তার মৃত্যু  সুনিশ্চিত ভেবে  ফরিদ উদ্দীন  তার কাছে থাকা গ্রেনেডের পিন খুলে দেন।

ফলে ৫ জন খান সেনা নিহত হন এবং তিনিও ঘটনাস্থলে শহীদ হন। তাকেও পাহাড়পুরে সমাধিস্থ করা হয়। আসির উদ্দীন বদলগাছীর সেন পাড়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। পিতা বশির উদ্দীন মন্ডল একজন দরিদ্র কৃষক। আসির উদ্দীন আনছার বাহিনীতে  ছিলেন। তার এস.এল.আর এর গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় পাক বাহিনীর গুলিতে ঘটনাস্থলে শহীদ হন। তাকেও পাহাড়পুরে সমাধিস্থ করা হয়। শহীদ আব্দুল গনি (বাগা মিয়া) বদলগাছী থানার চাপাডাল গ্রামের জনাব নাসির উদ্দীন মন্ডলের ২য় সন্তান ছিলেন। তার কাছে ছিল ৩০৩ রাইফেল ও ১০০ রাউন্ড গুলি।

গুলি শেষ হওয়ায় সে খান সেনাদের গুলিতে ঘটনাস্থলে শহীদ হন। তাকেও পাহাড়পুরে সমাধিস্থ করা হয়। এ.কে.এম ফজলুর করিম তৎকালীন বগুড়া জেলার আক্কেলপুর থানার আক্কেলপুর বাজারের আলহাজ্ব আব্দুর রহিম মন্ডলের পুত্র ছিলেন। ১৩ নং পান্না পার্টির মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে দুরন্ত সাহসী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী। পাহাড়পুর যুদ্ধে তাঁর কাছে ছিল একটি এল.এম.জি ও ৫টি লোডেড ম্যাগাজিন। যুদ্ধাবস্থায় গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় সে নিচু জমিতে আতœগোপনের চেষ্টকালে খান সেনারা তাঁকে ধরে ফেলে এবং ট্রাকে করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরূদ্ধে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারনা চালানেরার সময় ফজলুর করিম তাদের কাছ থেকে মাউথ পিছ ছিনিয়ে নিয়ে, ঘোষনা করেছিল বন্ধুগন আমার এল.এম.জি-র গুলি শেষ হওয়ায় আমি ধরা পড়েছি।

আমি সেচ্ছায় ধরা দেইনি। আপনারা আমার জন্য ভাববেন না। আমার জীবনের জন্য আমি একটুও চিন্তিত নয়। আমার লাখো ভাই মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিং নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আপনারা এইটুকু বিশ্বাস রাখুন অল্পদিনের মধ্যেই  এই দেশ স্বাধীনতা লাভ করবে।” তৎকালীন পাকবাহিনীর মেজর আফজাল হোসেন বেগ আতœসমর্পনের বিনিময়ে তাকে প্রান ভিক্ষা দিতে চাইলে অত্যন্ত রুঢ় ভাষায় তার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়। মেজর আফজাল বেগকে ফজলুল করিম বলেছিলেন আতœসমর্পন করার জন্য আমি যুদ্ধ শিখিনি। তোমাদের মত কুত্তার কাছে আতœসমর্পন করতে ঘৃনা বোধ করি। এইরূপ ঘটনা তার আন্তরিক পবিত্রতা ও অসীম সাহিসিকতার পরিচয় আজও জয়পুরহাট ও পাহাড়পুর বাসীর মুখে মুখে। এক সপ্তাহ ধরে তাকে নির্মম নির্যাতন করার পর জয়পুরহাটের নিকটস্থ কুঠিবাড়ি ঘাটে বেইনট চার্জ করে নদীতে নিক্ষেপ করে। তার মৃত দেহের কোন খোজ পাওয়া যায়নি।

ঐতিহাসিক পাহাড়পুরের যুদ্ধ একটি স্মরনীয় ঘটনা। উত্তরবঙ্গের মধ্যে গেরিলাদের সংগে পাক বাহিনীর এতবড় যুদ্ধ আর কোথাও সংগঠিত হয়নি। এই যুদ্ধে ১১৫ জন খান সেনা ও ২০ জন রাজাকার খতম হয়েছিল। শহীদ হয়েছিল ৬ জন বীরমুক্তিযোদ্ধা ও আহত হয়েছিল ১ জন। পান্না বাহিনী ২৫ নভেম্বর তৎকালীন নওগাঁ মহকুমার বদলগাছী থানা মুক্ত করার জন্য রওনা হয়ে যমুনা নদী পাড়ে পাকবাহিনীর এ্যাম্বুসে পড়ে। এক ঘন্টা গোলাগুলির পর পাক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। বেলা ৩টা ১০ মিনিটে পান্না বাহিনী বদলগাছী থানা মুক্ত করে দখলে নিয়ে আসে। এবং এক্সপোসিপ দিয়ে থানা উড়িয়ে দেয়।

তথ্যগুলি ফরমুজুল হক পান্নার ’৭১ এর ডাইরী থেকে সংগৃহিত। সেই দিনের সন্মুখ যোদ্ধা যুদ্ধ কালীন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা পাহাড়পুরের সামসুল আলম জানান গ্রামে গ্রামে মুক্তিযোদ্ধরা লুকিয়ে থাকে। এখবর পেয়ে জয়পুরহাট থেকে পাকসেনারা এসে পাহাড়পুর এলাকার ৯টি গ্রামে বাড়ী ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং ১৭জন মানুষকে হত্যা করে। এ সময় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামবাসী ছুটে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের বলে আপনারা গ্রামে থাকার জন্যে পাকসেনারা গ্রামে আগুন দিচ্ছে আপনারা যুদ্ধ করেন। ঘটনার দিন পাকসেনারা যখন রনাহার গ্রামে আগুন দেয় তখন পাকসেনাদের এ্যাম্বুশে ঘিরে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধরা পাকসেনাদের সঙ্গে সন্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন।

সেখান থেকে পাকসেনা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিছু পর আবারও শুরু হয় দ্বিতীয় দফা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ১২৫ জন পাকসেনা ১৭ জন আজাকার নিহত হয়। ৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ঐ কমান্ডার আরো জানায় উত্তরবঙ্গে এতো বড় যুদ্ধ কোথাও হয়নি। আমাদের দাবী ছিল পাহাড়পুরে একটি শহীদ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ তা এখনো পাইনি।

১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বরের কয়েকদিন পূর্বে বদলগাছী আক্কেলপুর সড়কে পাক বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে  হলুদবিহার গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোকলেছুর রহমান তার হাতে থাকা এল.এম.জি জ্যাম হওয়ায়  পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। মকলেছু কে চলন্ত গাড়ীর পিছনে বেধে নিয়ে হানাদার বাহিনী আক্কেলপুর ক্যাম্পে নিয়ে নির্মম নির্যাতনে শহীদ হন।  মোকলেছুর রহমানের লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.