সন্তানের স্বপ্ন চুর্ন বাবা-মার ডিভোর্স দন্দে

 

কালের সংবাদ ডেস্কঃ ২০১০ সালে বিয়ে হওয়া পুলিশ বিভাগের এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহেদ ফেরদৌস রানা ও অপরদিকে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ডা. তামান্না ফেরদৌস মৌরীর সুখের সংসারে ২০১৭ সালে এক পুত্র সন্তান এবং ২০১৯ সালে এক কন্য সন্তানের জন্ম হয়। সন্তাদের নিয়ে সুখেই কাটছিল তাদের সংসার। এগিয়ে চলছিল সংসার সুন্দ স্বপ্নে। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই মতের বনিবনা ও মতের অমিল দেখা দেয়। একপর্যায়ে ২০২১ সালের ২২শে মার্চ দুজনের সম্পর্কে ছেদ পড়ে ডিভোর্স হয়ে যায়।

এখন দুই সন্তান রয়েছে বাবার কাছে। চিকিৎসক মা এখন সন্তানের হেফাজত, দেনমোহর ও খোরপোষ পেতে আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। ঢাকার ৩য় সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতে সাবেক স্বামী পুলিশ কর্মকর্তা মুহাম্মদ শাহেদ ফেরদৌস রানার বিরুদ্ধে ঠুকে দিয়েছেন ২টি মোকদ্দমা। প্রথমটি সন্তানের হেফাজত ও দ্বিতীয়টি দেনমোহর ও খোরপোষ আদায়ের জন্য।

জানা যায়, চিকিৎসক তামান্না ফেরদৌস ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর সন্তান। তার পিতা ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বর্তমানে একটি হাসপাতালে রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। ২০১০ সালের ১৭ই অক্টোবর ৫ লাখ টাকা দেনমোহর ধার্য করে কাকরাইলে চিকিৎসকের পিত্রালয়ে বিবাহ সম্পন্ন হয়। ওয়াশিল বাবদ ৪ লাখ টাকা মূল্যমানের ১০ ভরি স্বর্ণালংকার প্রদান করেন। কিন্তু সেই স্বর্ণ জোরপূর্বক ব্যাংকের লকারে রেখে দেন বলে অভিযোগ চিকিৎসকের।সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতেও দেন না।

মোকদ্দমায় চিকিৎসকের অভিযোগ, বিয়ের পর বিবাদী পুলিশ কর্মকর্তা ও পরিবারের লোকজন বাদিনীর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে আসছিলেন। এরপর গত বছরের ২২শে মার্চ বনিবনা ও মনের মিল না হওয়ায় বিবাদী জোরপূর্বক কৌশলে বাদিনীকে স্ত্রী কর্তৃক তালাক দিতে বাধ্য করেন এবং তাকে এক কাপড়ে ২ সন্তানসহ বাসা থেকে বের করে দেন। এরপর ওই বছরের ১০ই মে বিবাদী তার দুই সন্তানকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে যান। এমনকি বাদিনীকে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে ও কথা বলতে বাধা প্রদান করে আসছেন। বাদিনী তার সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে ও কথা বলতে চাইলে তাকে নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদান করে আসছেন। আরেক মোকদ্দমায় চিকিৎসকের অভিযোগ, দেন মোহরের পাপ্য একলাখ, দুইলাখ টাকা মূল্যের বেসিক মেডিকেল সম্পর্কিত বইপত্র, লেকচার শীট এবং ৫ লাখ টাকার অধিক মূল্যের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, কাপড়চোপড় ও বিভিন্ন ব্যান্ডের ব্যবহার্য সামগ্রী, ওয়াশিলের ৪ লাখ টাকা মূল্যের ১০ ভরি স্বর্ণালংকার ও নগদ ১ লাখ টাকা প্রদান করতে আদালতের কাছে আর্জি জানানো হয়।

বাদিনীর আইনজীবী এইচ এম মাসুম বলেন, দুই সন্তানের সঙ্গে মাকে দেখা করতে না দিয়ে তাদেরকে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। যেহেতু বাদিনীর ছেলের বয়স ৬ বছর ও মেয়ের বয়স ৪ বছর। সেহেতু তারা দুজনই এখনো নাবালক। বাংলাদেশের আইনানুয়ায়ী তারা মায়ের জিম্মায় থাকার হকদার। একইসঙ্গে কাবিনের টাকা ও খোরপোষের হকদার। এ বিষয়ে প্রথমে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বরাবর উকিল নোটিশ পাঠানো হয়। পরে প্রতিকার পেতে বাদিনীর পক্ষে পারিবারিক আদালতে দুটি মামলা করেছি।

এদিকে বাদিনীর উকিল নোটিশের জবাব দিয়েছেন বিবাদীর আইনজীবী মোহাম্মদ ওমর ফারুক আসিফ। জবাবে আইনজীবী বলেন, নোটিশের জবাবদাতা মুহাম্মদ শাহেদ ফেরদৌস রানা ২৫তম বিসিএস-এ এএসপি পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে বতর্মানে এসপি পদমর্যাদায় কর্মরত। তার মৃত পিতা একজন চিকিৎসক ও ডাইরেক্টর স্বাস্থ্য হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। মাতাও একজন চিকিৎসক। দুই বোনের মধ্যে একজন চিকিৎসক, আরেকজন প্রকৌশলী। তারা বাংলাদেশের একটি সুশিক্ষিত ও স্বনামধন্য পরিবারের সন্তান। কিন্তু বাদিনী পরকীয়া প্রেমে আসক্ত হয়ে স্বেচ্ছায় গত বছরের ৩রা ফেব্রুয়ারি ৪টি বড় সাইজের সুটকেস, ৮/৯টি ছোট বড় ব্যাগ, দেনমোহরের টাকা, সকল স্বার্ণালংকারসহ পিতার বাড়ির গাড়ি ডেকে এনে সন্তানদের নিয়ে পিত্রালয়ে চলে যান। পরবর্তীতে একই বছরের ২২শে মার্চ তালাক প্রদান করে দেড় মাসের মাথায় অন্য পুরুষকে বিয়ে করেছেন। অবৈধ প্রেমকে বৈধতা দিতে নিজের ভোগ বিলাসিতায় মত্ত থাকার সুবিধার্থে সন্তানদের স্বেচ্ছায় বিবাদীর কাছে দিয়েছেন। বিগত দুই বছরে সন্তানদের কোনো খোঁজখবর নেননি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা নাসরিনের মতে, ডিভোর্সের পর সন্তান নিয়ে মা-বাবার টানাটানির অবসান করতে নিকাহনামার ফরমে বা আলাদাভাবে চুক্তি করে হলেও বিয়ের সময় ভবিষ্যতে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে ও শিশু থাকলে তাদের ভরণপোষণ, শিক্ষা, জিম্মা ও অভিভাবকত্বের বিষয়গুলো সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব দায়দায়িত্বকে বহন করবে, তা বিয়ের সময় উল্লেখ থাকলে বাবা ও মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ হলে বা বিচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় শিশুকে ভুগতে হয় না।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিরুল ইসলামের মতে মুসলিম আইন অনুযায়ী পিতাই অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের আইনগত অভিভাবক। মা হচ্ছেন সন্তানের তত্ত্বাবধায়ক। সন্তানের মা যদি বাবার কাছ থেকে আলাদা থাকেন কিংবা তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়, তাহলে মা তার সন্তানের তত্ত্বাবধান করার ক্ষমতা হারাবেন না। ছেলের ক্ষেত্রে ৭ বছর বয়স পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তানের বয়সন্ধি বয়স পর্যন্ত মা সন্তানদের নিজের কাছে রাখতে পারবেন। সন্তানের মঙ্গলের জন্য যদি মায়ের তত্ত্বাবধানে রাখার আরও প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে এ বয়সসীমার পরও মা সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারবেন। তবে এজন্য আদালতের অনুমতির প্রয়োজন হতে পারে। মা যদি দ্বিতীয় বিয়ে করেন, তাহলে সন্তানকে নিজের হেফাজতে রাখার ক্ষমতা হারাতে হতে পারে। একই কথা বলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শ্রেষ্ঠ আহমেদ রতন। তিনি বলেন, মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী সন্তান ছেলে হলে এক বিধান, মেয়ে হলে আরেক বিধান। ছেলের ৭ বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের তত্ত্বাবধানে থাকবে। মেয়ে হলে সাবালক হওয়া পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবে। তবে আইনে যাই থাকুক না কেন, আদালত যদি মনে করেন সন্তানের কাস্টডিয়ান (হেফাজত) মায়ের তত্ত্বাবধানে রাখলে তার মানসিক বিকাশ ও শিক্ষা অর্জনে সহায়ক হবে সেক্ষেত্রে আদালত সন্তানকে যে কারও হেফাজতেই দিতে পারেন। তবে সন্তানকে মায়ের হেফাজতে দিলেও ভরণপোষণ কিন্তু পিতাকেই বহন করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.