ছোট্ট প্রিন্স চার্লস তিন বছর বয়সে মায়ের মাথায় মুকুট উঠতে দেখেছিলেন

কালের সংবাদ আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানে ওয়েস্টমিনস্টারে বসেছিল তারার মেলা। ছিলেন রাজপরিবারের সদস্যরা। তিন বছর বয়সে মা দ্বিতীয় এলিজাবেথের মাথায় ক্রাউন বা মুকুট উঠতে দেখেছিলেন ছোট্ট প্রিন্স চার্লস। ৭০ বছর পরে ক্ষমতার সেই মুকুট তার মাথায়। তিনি এখন বৃটেনের রাজা চার্লস তৃতীয়। ঐতিহাসিক এক রাজ্যাভিষেকের মধ্যদিয়ে তিনি জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বৃটেনের রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন শনিবার। সাত দশকের মধ্যে সবচেয়ে বিলাসবহুল অনুষ্ঠানে তিনি শপথ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে’তে তার মাথায় ৩৬০ বছর বয়সী সেইন্ট এডওয়ার্ডের ক্রাউন বা মুকুট পরিয়ে দেন আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবারি জাস্টিন ওয়েলবি। এ সময় চতুর্দশ শতাব্দীর একটি সিংহাসনে বসা ছিলেন রাজা চার্লস। একই অনুষ্ঠানে কুইন বা রানী হিসেবে মুকুট পরিয়ে দেয়া হয় তার স্ত্রী ক্যামিলাকে।

সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসীরা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। উপস্থিত ছিলেন বিনোদন জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিরা। সব মিলিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রায় ২২০০ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি।

রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠান উপলক্ষে পুরো বৃটেনে সাজ সাজ রব পড়ে যায় আগে থেকেই। রাস্তায় রাস্তায় মানুষ উল্লাস করতে থাকেন। বাকিংহাম রাজপ্রাসাদ থেকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে যাওয়ার পথে রাজা ও রানীকে অভিবাদন জানান তারা। জাতীয় পতাকা দুলিয়ে, উল্লাস করে সেলিব্রেট করেন। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজা তৃতীয় চার্লসের বড় ছেলে প্রিন্স উইলিয়াম, তার স্ত্রী কেট মিডলটন ও তাদের সন্তানরা। আরও উপস্থিত ছিলেন রাজার ছোট ছেলে প্রিন্স হ্যারি। পিতার রাজ্যাভিষেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে একাই উড়ে এসেছেন। অনুষ্ঠান শেষে আবার ফিরে যাওয়ার কথা। কারণ, একই দিনে তার সন্তানের জন্মদিন।
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে’তে রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবারি জাস্টিন ওয়েলবি। রাজাকে অভ্যর্থনা থেকে শুরু করে শপথ পড়ানো, মুকুট পরানো, প্রায় পুরোটাই করেন ওয়েলবি। তিনি মুকুট পরিয়ে বলেন, রাজা যেন সব বিশ্বাসের মানুষের জন্য আশীর্বাদ হন। তিনি লাখ লাখ মানুষের সেবা করতে পারেন। এর মধ্যদিয়ে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে তিনি ৪০তম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে সিংহাসনে বসলেন।

এরপরই রাজা ও পিতা তৃতীয় চার্লসের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার ছেলে প্রিন্স উইলিয়াম। তিনি হাঁটু গেড়ে পিতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তার কাছে অনুগত থাকার শপথ নেন। এরপর প্রিন্স উইলিয়াম দাঁড়িয়ে যান। রাজার মাথার মুকুট স্পর্শ করেন। রাজার চিবুকে চুম্বন দেন। এ সময় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন রাজা চার্লস। তিনি সন্তানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেনÑ ধন্যবাদ, উইলিয়াম।

নানা দিক দিয়ে এই অনুষ্ঠান ছিল ঐতিহাসিক। আবেগের। বিশ্বজুড়ে মানুষ সরাসরি সম্প্রচারে দেখেছেন এ অনুষ্ঠান। এর মধ্যদিয়ে রাজার গন্তব্য- সিংহাসনে আরোহণ সম্পন্ন হলো। তা সত্ত্বেও তার মনে, রাজপরিবার, বিশেষ করে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে রাজার মা প্রয়াত রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের চলে যাওয়ার ছাপ বিদ্যমান ছিল। এই তো গত সেপ্টেম্বরে লাখ লাখ মানুষের ভালোবাসা নিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরবিদায় নেন রানী এলিজাবেথ। এর মধ্যদিয়ে তার ৭০ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। তারই মনোনীত বড় ছেলে প্রিন্স চার্লস হন নতুন রাজা।

শনিবার মুকুট পরানোর আগে জনগণের দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে রাজাকে পবিত্র তেল দিয়ে অভিষেক করা হয়। তাকে কলোবিয়াম সিন্দোনিস নামের একটি সাদা লিলেন গার্মেন্টে তৈরি বিশেষ পোশাক পরানো হয়। তার ওপর পরানো হয় সুপারটুনিকা নামের একটি স্বর্ণালী কোট। এরপর নানা আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এর কয়েক মিনিট আগে বাইবেল ছুঁয়ে এবং তাতে চুম্বন করে শপথ নেন রাজা তৃতীয় চার্লস। এ সময় তার পরিবারের ঘনিষ্ঠজনরা কাছাকাছি অবস্থান করছিলেন। শপথ গ্রহণ, পোশাক বদল, তেল পরানো, মুকুট পরানোÑ ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা পাশে বসে উপভোগ করছিলেন কুইন ক্যামিলা। এক পর্যায়ে তাকেও মুকুট পরিয়ে দেয়া হয়।
দিনের শুরুতে রাজা ও রানী ঐতিহাসিক গোল্ড স্টেট কোচে চড়ে বাকিংহাম রাজপ্রাসাদ থেকে বের হন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের উদ্দেশ্যে। এই কোচটির ওজন চার টন। বৃটেনে আমেরিকান কলোনির সর্বশেষ রাজা তৃতীয় চার্লসের জন্য এটি তৈরি করা হয়েছিল। বাকিংহাম প্যালেস থেকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে’র দূরত্ব ১.৩ মাইল। এই পুরো পথে অবস্থান নেন কয়েক লাখ মানুষ এবং সাত হাজার বৃটিশ সেনা। উপস্থিত এসব জনতা ‘রাজা চার্লসকে ঈশ্বর রক্ষা করুন’ স্লোগানে কাঁপিয়ে তোলে। কোচের ভেতর থেকে রাজা ও রানী হাত নেড়ে তাদের সমর্থন, উল্লাসের জবাব দেন। রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে কার্ডিফ ক্যাসেলে ২১বার তোপধ্বনি দেয়া হয় টাওয়ার অব লন্ডনে এবং রাজধানীজুড়ে, জিব্রাল্টায়, বারমুডায়, সমুদ্রে থাকা জাহাজগুলোতে। বিভিন্ন পার্কে, শহরে জায়ান্ট স্ক্রিনে সরাসরি রাজ্যাভিষেক দেখানো হয়। এ জন্য এসব স্থানে আগে থেকেই বিপুলসংখ্যক মানুষ ভিড় জমান। ১৯৫৩ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের তুলনায় চার্লসের শনিবারের ইভেন্ট কিছুটা ছোট আকারের ছিল। এখানে উল্লেখ্য, সেপ্টেম্বরে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ মারা যাওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার উত্তরাধিকারী হয়ে ওঠেন ৭৪ বছর বয়সী চার্লস। তারই অভিষেক হলো শনিবার। এই রাজ্যাভিষেক অত্যাবশ্যক নয়। কিন্তু জনগণের কাছে রাজার বৈধতা হিসেবে একে দেখা হয়। অভিষেক শেষে রাজা-রানী ফিরে যান বাকিংহাম রাজপ্রসাদে। সেখানে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন তারা। ওদিকে রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ায় চার্লসকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তিনি বলেছেন, বৃটেনের সঙ্গে সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় বিস্তৃত করতে ইচ্ছুক চীন। তিনি আরও বলেন, উভয় দেশ যৌথভাবে শান্তি এবং সহযোগিতাকে উৎসাহিত করতে পারে।

রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকলেও রাজ্যাভিষেকে উপস্থিত হয়েছিলেন বৃটেনের বড় সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। এর মধ্যে আছেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। বিরোধী লেবার দলের নেতা কিয়ের স্টর্মার। রক্ষণশীল কনজারভেটিভ দল থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, লিজ ট্রাস, ডেভিড ক্যামেরন। অনুষ্ঠান শেষে বৃষ্টি শুরু হলেও তারা একসঙ্গে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। তবে জনসন তার স্ত্রী ক্যারির হাতে হাত ধরা ছিলেন। গতকালের এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হননি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। অনুষ্ঠান উপভোগ করতে যোগ দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক পেগি জেন লেভার (৭৯)। তিনি বলেন, আমি যখন টিনেজার ছিলাম তখন কানেক্টিকাটে বসে টেলিভিশনে দেখেছিলাম রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক। আর এখন আমি ব্যক্তিগতভাবে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পেরে পুলকিত বোধ করছি।

যে কারণে যাননি বাইডেন বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার দেশের ‘বিশেষ সম্পর্ক’ ঘোষণা করেছিলেন। এরপর দশকের পর দশক ধরে দুই দেশের মধ্যে অসাধারণ সম্পর্ক বিরাজ করছে। কিন্তু তারপরেও বৃটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন জো বাইডেন। এমন সুযোগ পুরো এক জীবনে দুই-একবারের বেশি পাওয়া যায় না। তারপরেও বাইডেন কেন গেলেন না এই অনুষ্ঠানে? বিবিসি জানিয়েছে, শুধু বাইডেনই নয়, এখন পর্যন্ত কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টই বৃটেনের রাজপরিবারের অভিষেক অনুষ্ঠানে অংশ নেননি। সব থেকে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এর পেছনে কোনো কারণও নেই। বৃটিশ রাজাদের অভিষেকে যোগ না দেয়াকেই সংস্কৃতিতে পরিণত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, বাইডেন অভিষেক অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পেয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজে না গিয়ে তার স্ত্রী ফার্স্টলেডি জিল বাইডেন ও একটি কূটনৈতিক দল পাঠাবেন বলে রাজা চার্লসকে ফোনে জানিয়েছিলেন। বাইডেন কেন অনুপস্থিত থাকবেন সে বিষয়ে হোয়াইট হাউস কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। তারা বলেছে, বাইডেন ভবিষ্যতে কোনো এক সময় বৃটেনে গিয়ে রাজার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন।

আমেরিকান ইউনিভার্সিটির বৃটেন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর লরা বিয়ারস বলেন, অভিষেকে না যাওয়া প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পক্ষ থেকে কোনো অপমানসূচক ইঙ্গিত বলে আমি মনে করি না। তিনি যাচ্ছেন না কারণ কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট আজ পর্যন্ত অভিষেকে যাননি। কাজেই এই একবিংশ শতকে এসে নতুন করে কেন শুরু করা! রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনামলের আগে বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শত্রুতামূলক সম্পর্কই ছিল। রানী ভিক্টোরিয়া সিংহাসনে বসার পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পায়, বৃটিশ রাজতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মুগ্ধতা তৈরি হয়। কিন্তু তবুও সে সময়কার মার্কিন প্রেসিডেন্ট মার্টিন ভ্যান বুরেন রানী ভিক্টোরিয়ার অভিষেকে অংশগ্রহণ করেননি। সে সময়কার বাস্তবতায় একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বৃটেনে উপস্থিত হয়ে অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া কার্যত সম্ভব ছিল না। আর সে কারণেই এরপর থেকে এটি রীতি হিসেবে তৈরি হয়ে গেছে।

যায়নি যেসব দেশ অভিষেক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় বিশ্বের প্রায় সকল দেশকেই। তবে বাদ পড়ে রাশিয়া, বেলারুশ, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ভেনিজুয়েলা ও ইরান। ফলে এসব দেশের নেতারা অনুষ্ঠানে যোগ দেন নি। এ ছাড়া উত্তর কোরিয়া ও নিকারাগুয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের পরিবর্তে সিনিয়র কূটনীতিকদের আমন্ত্রণপত্র জারি করা হয়েছিল। তারাও যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published.