তখন তিনি প্রস্তাবে উল্লেখ করেন, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন এবং আইন-আদালতের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হোক এবং সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, সে সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব জনগণের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গৃহীত হোক।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর এভাবেই সর্বপ্রথম মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার দাবি উচ্চারিত হয়েছিল যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের দারা। ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের লেখা, ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ পুস্তকে এর বর্ণনা পাওয়া যায়।
১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা আদায়ের জোরালো দাবি উত্থাপিত হয়, যার অন্যতম কুশীলব ছিলেন “ যুবকদের মধ্যমনি শেখ মুজিব”।
তৎকালীন প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় (যা পড়ে বুয়েট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়) (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং ঢাকা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জন ও দলে দলে যোগদানের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ১৯৪৮-এর ২৬ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম বাংলা ভাষার পক্ষে অনুষ্ঠিত এই সফল সমাবেশের ব্যবস্থাপনা এবং সফলতার কৃতিত্ব দেন তৎকালীন যুবনেতা শেখ মুজিবকে।
শেখ মুজিব সহ প্রগতিবাদী ছাত্র ও যুব নেতারা এ সমাবেশে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার এবং সর্বাত্মক সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ১৯৪৮-এর ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম ছাত্র হলে অনুষ্ঠিত মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিসের যৌথ সভায় নতুন করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। শেখ মুজিব ছাড়াও এই সভায় উপস্থিত ছিলেন সামছুল হক, আবুল কাশেম, রনেশ দাস গুপ্ত, অজিত গুহ, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা।
১১ মার্চের হরতাল যেকোনো মূল্যে সফল করার আহ্বান জানানো হয় সেই সময়ের ১৯৪৮-এর ১ মার্চ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রদত্ত বিবৃতিতে। বিবৃতিতে স্বাক্ষর দেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান, তমদ্দুন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম, মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদিন আহমেদ ও আবদুর রহমান চৌধুরী।
১১ মার্চ সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এই হরতাল প্রথমবারের মতো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চিন্তাকে নাড়া দেয়। এই হরতাল চলাকালে শেখ মুজিব পুলিশি হামলায় আহত ও গ্রেপ্তার হন। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা অলি আহাদ তাঁর লিখিত গ্রন্থে উল্লিখিত ঘটনায় শেখ মুজিবের সাহসী ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
শেখ মুজিবই প্রথম রাজবন্দি, যিনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে মাতৃভাষা আন্দোলনের জন্য সর্বপ্রথম গ্রেপ্তার হন।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ১৯৪৮-এর ১৫ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের আট দফা চুক্তি অনুসারে শেখ মুজিবসহ অন্য ভাষাসংগ্রামীরা কারামুক্ত হন। ভাষাসংগ্রাম আরো তীব্র করার লক্ষ্যে ১৬ মার্চ (১৯৪৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শেখ মুজিবের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা থেকে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে (পুরনো জগন্নাথ হল ছাত্রাবাস) বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় ভাষাসহ অন্যান্য দাবি পেশ করার লক্ষ্যে। পর দিন ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুসারে ওই দিন দেশব্যাপী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূলত ভাষার দাবিতে সফল ধর্মঘট পালিত হয়। দৃঢ় প্রত্যয়ী এবং আন্দোলন প্রশ্নে অবিচল শেখ মুজিব ক্রমেই ছাত্র-যুবসমাজের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি পেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় ১৯৪৯-এ শেখ মুজিব দুবার কারারুদ্ধ হন।
ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখনো শেখ মুজিব কারাগারে ছিলেন। কারা অভ্যন্তরে থেকেও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা পাঠাতেন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন চলাকালীন বাঙালিদের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলা ভাষার বিপক্ষে বিবৃতি দিলে আন্দোলন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়।
মুক্তিলাভের পর শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীকে তাঁর মত পরিবর্তন করিয়ে বাংলা ভাষার পক্ষে নতুন করে বিবৃতি প্রদানে বাধ্য করেন, যা শেখ মুজিবের পক্ষেই সম্ভব ছিল বলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অভিমত ব্যক্ত করেন।
১৯৫২ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে এ বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এ বিবৃতি ভাষাসংগ্রামীদের নতুন করে অনুপ্রাণিত করে। ১৯৫৩-এর একুশের প্রথম বার্ষিকী উদ্যাপনে শেখ মুজিব অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আরমানীটোলায় অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার জোর দাবি জানান।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ শতাংশের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও এর স্থলে সংখ্যালঘু মাত্র ৫ শতাংশের ভাষা উর্দুকে অযৌক্তিক ও অনৈতিকভাবে চাপিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাঙালি ক্রমেই ঐক্যবদ্ধ হয়। মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায় বায়ান্নতে রক্ত ঝরে ঢাকার রাজপথে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার মহান আন্দোলনই বাঙালি জাতিকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা তথা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে। মাতৃভাষা আন্দোলনের এবং পর্যায়ক্রমে চলমান প্রতিটি আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সুযোগ্য নেতৃত্ব আমরা দেখতে পাই।