সামরিক ইতিহাস-ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ও বাংলাদেশের পঞ্চাশ বৎসর

মোঃ নাসিমুল গনি, পিএইচডি, এমডব্লিউএস, এমডিএস, এএফডব্লিউ, পিএসসি (অব): বলা হয় ইতিহাস কথা বলে এবং একই সাথে সামরিক ইতিহাস ইতিহাসের অতি অপরিহার্য অঙ্গ। পৃথিবীতে মানব সভ্যতার ইতিহাসের সাথে সাথে সামরিক ইতিহাসকে কেউ উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করতে পারেনি।

এটি আপনাতে ইতিহাসের সাথে মিশে গিয়েছে। সামরিক শক্তির ইতিহাসকে ইতিহাসের অন্যান্য অঙ্গ শুধুমাত্র অনুসরণ করেই নতুন নতুন সভ্যতার সৃষ্টি করেছে। এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, সামরিক নেতৃবৃন্দ ও রাজতন্ত্রে/নেতৃত্ব ব্যবস্থাপনার যে কোন কাজেই সকল সময় সর্বোচ্চ পদাধিকার বলে একই ব্যক্তি ছিলেন এবং আছেন। ঐ ব্যক্তির সামরিক প্রশিক্ষণ ও প্রজ্ঞার উপর দেশের ইতিহাস রচিত হয়। আমাদের চিরচেনা মহামতি আলেকজেন্ডার দি গ্রেট, বিসমার্ক, মহামতি ফ্রেডরিক, হযরত উমর (আ:), মোঘল সম্রাট বাবর ও আওরঙ্গজেব, শেরশাহ সুরী, চেঙ্গিস খান, আইসেন হাওয়ার, চার্চিল, কামাল আতাতুর্ক, সুকর্নো, জেনারেল গিয়াপ, নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, আইয়ুব খান, মোহাম্মদ গাদ্দাফী, মুসাভেনী, টিটো, স্টালিন, হিটলার ইত্যাদি ।

রনবিদ্যায় পারদর্শী হয়েও পরবর্তীতে রাজনৈতিক ভূমিকায় নিজেদেরকে সমভাবে যোগ্য ও উপযুক্ত হিসাবে প্রমান করেছেন। এছাড়া সামরিক নেতৃত্ব বিবিধ বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। যেমন দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর জাপান ও কোরিয়ার পুনর্গঠনে তৎকালীন মার্কিন সেনানায়ক জেনারেল ম্যাকআর্থারের ভূমিকা এখনও আলোচনার বিষয়ব¯দ। ইতিহাসের উষালগ্ন হতে “উন্নয়ন ও নিরাপত্তা” (উবাবষড়ঢ়সবহঃ ধহফ ঝবপঁৎরঃু) অঙ্গাঁঅঙ্গীভাবে জড়িত। তাই অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে তাকে সার্বজনীন ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য সার্বিক নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়। পৃথিবীতে যুগে যুগে অর্থনীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়েছে। তবে তার নূন্যতম বা ব্যাপকতা নির্ভর করেছে সেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন “ন্যায় অথবা অন্যায়ের” উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে কিনা। ১৮৮৪ সালের বার্লিন সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইউরোপীয় শক্তির দেশসমূহের মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশকে ঔপনিবেশিক হিসাবে বিভক্ত করে নেয়া হয় তা ছিল অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে টিকে থাকার জন্য অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বন্দোবস্তযা অনৈতিক/অন্যায্য প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। অনুরূপভাবে ¯œায়ুযুদ্ধের সময় দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে অনৈতিক নিরাপত্তা সংশয় ন্যাটো ও ওয়ারস প্যাক্টের সৃষ্টি করে যার কুফল হিসাবে আজকের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বর্তমান বিশে^ও অনৈতিক অর্থনৈতিক কারণে নিরাপত্তা ব্যবস্থার নবায়নের সুযোগ হয়েছে এবং বিশে^র দেশসমূহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামরিক গ্রুপিং ও পাল্টা গ্রুপিং করছে।

এগুলো উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হলো ইতিহাসের বিষয়গুলো যখনই রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদিকে তুলে ধরে তখন সবাই তাতে উচ্ছাসিত হয়ে সামরিক ইতিহাসকে অজ্ঞাতে নিতে চায়। তাই সকল সময় সামরিক ইতিহাস হয় উপেক্ষিত ও অবহেলিত । বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ ও বর্তমানের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে এইরুপ ভাবে উল্লেখ করা যায়। রনাঙ্গনের পরিবেশিত সীমিত সংবাদ এবং মৃত, আহত এবং জীবিত সৈনিকদের বেদনার প্রচন্ড ভারকে স্বাভাবিক ও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হিসাবে নেয়া হয় । তখন মানবতা ও ইতিহাসের সত্য থমকে থাকে/চাপা পড়ে যায় । ইতিহাসবিদরা পরবর্তীতে এ নিয়ে আলোচনা/সমালোচনার ঝড় তোলে। কিšদ সাধারণ মানুষ এবং সৈনিকদের কোন কল্যাণ হয় না । প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে যে বিপুল পরিমান ভারতীয় সৈনিক নিহত এবং আহত হয়েছিল তাদের বিষয়ে কল্যানমূলক কার্যক্রম তাদের ত্যাগের বিপরীতে অতি নগন্য ছিল । এই বিষয়টি নিয়ে খুব কম আলোচন হয়েছে । ইতিহাস সবসময় পূর্বের কথা বলে।

সামরিক ইতিহাসকে তাই পূর্ব, বর্তমান ও ভবিষ্যতের আঁচলে বেধে আলোচনা ও ব্যবহার করতে হবে। তখনি একটি সমাজ, রাষ্ট্র বা বিশ^ ঐ সব অভিজ্ঞতা হতে শিক্ষা নিয়ে নৈতিকভাবে বিজয়ী হবে । বাংলাদেশের ইতিহাসের সারমর্মে বলা যায় যে ১৭৫৭ সালের বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে পরাধীন হবার পূর্বে যত বিজেতা, ধর্ম প্রচারক, বণিক, শিল্পী ইত্যাদির এসেছে তারা (মঙ্গোল ব্যতিত) এ দেশকে তাদের কর্ম ও প্রতিভা তারা পরিপূর্নকরে এ দেশের মাটি ও মানুষের সাথে লীন হয়ে গিয়েছে। বৃটিশরা এ দেশে শুধুমাত্র শাসক ও শোষক হিসাবে থেকেছে। কিšদ কখনই এ দেশকে তাদের নিজেদের দেশ হিসাবে গ্রহণ করেনি। ফলশ্রুতিতে ইতিহাস হয়েছে কলংকিত এবং সামরিক ইতিহাসকে যতদূর সম্ভব দূরে রাখা হয়েছে। দীর্ঘদিন পর শুধুমাত্র কারো সদিচ্ছা থাকলে সীমিতভাবে ইতিহাস চর্চা করা যায় ।

সুতরাং অবিভক্ত ভারতের সামরিক ইতিহাস আপাময় জনগণের পক্ষে সঠিক ইতিহাস উদঘাটন কখনই সম্ভব নয়। আমরা যা পাই তা হলো খন্ডিত এবং তার আলোকে ইতিহাসের নতুন রচনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। তাই দেখা যায় ব্রিটিশ ভারতে সামরিক ইতিহাস হয়েছে খন্ডিত, একপেসে এবং প্রকৃত সত্য হতে বহুদূরে। শিক্ষিত ও জ্ঞানবান বাঙ্গালী ও ভারতীয়দের ইতিহাস লেখা/সত্য ভাষণ হতে দূরে থাকার প্রবনতার কারণে ভবিষৎ প্রজন্মকে নির্ভর করতে হয়েছে বিদেশী লেখক ও ইতিহাসবিদদের উপর। এখনও ব্রিটিশ ভারতের ১৯০ বৎসরের ছোট ও বড় প্রতিবাদ, বিদ্রোহ, প্রতিরোধ, আত্মাহুতী, আত্মত্যাগ ইত্যাদি আমাদের কাছে অজানা এবং হয়তোবা আর কোনদিন জানাও যাবে না। অবিভক্ত ভারতের সামরিক ইতিহাস এই ত্যাগীদের স্মরন ও সন্মান করতে পারছেনা । এই দেশের সূর্যসন্তানরা নতুন প্রজন্মের নিকট সম্পূর্ন অপরিচিত ও তাদের অবদানকে স্বীকার করতে দ্বিধাবিভক্ত । এই প্রেক্ষাপটেই আজ বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাস নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পাচ্ছি।

১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্থান বিভক্তির পরবর্তীতে পাকিস্তানে সরকার কর্তৃক মার্কিন অর্থনৈতিক ও সামরিক জোটে যোগদানের কারণে ভূরাজনৈতিক জটিলতায় দেশের সামরিক ইতিহাসের নূতন অধ্যায় শুরু হয়। পাকিস্তান সরকারকে বিপ্লব/সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে উৎখাত করার জন্য কমিউনিস্ট, বামপন্থীদলসমূহ, মাওলানা ভাসানী, সিরাজুল আলম খানের স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস, সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি ইত্যাদিদের উপাখ্যান, ভূমিকা এবং তৎপরতা আমাদের সামরিক ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মেজর গনির বাঙ্গাঁলী সেনাদল গঠনের প্রয়াস এবং লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম ও তার সহযোগীদের স্বশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তাবনায় জড়িত (আগরতলা মামলা) অফিসার ও সৈনিকদের ইতিবৃত্ত আজ প্রায় সবার নিকট অজানা । ১৯৬৫ সালের পাকিস্থান-ভারত যুদ্ধে স্কোয়াড্রন লিডার আলম, গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজম, ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টর কর্মকান্ড স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দীর পর প্রায়ই নিখোঁজ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, কোন রাজনৈতিক সমঝোতা বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার আলোকে নয়। সুতরাং, এই স্বাধীনতার প্র¯দতির সামরিক ইতিহাস থাকতে বাধ্য এবং তা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক অনৈতিক ও বিশসঘাতকতামূলক রাজনৈতিক চাতুর্য্যরে প্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টসমূহ সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। সারা দেশের পুলিশ, আনসার, ইপিআর বিচ্ছিন্নভাবে ইস্টবেংগল রেজিমেন্টের বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়। ০৪ এপ্রিল ৭১ সালে সিলেটের তেলিয়াপাড়ার চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলোয় বিদ্রোহী সেনা নেতৃবৃন্দের সম্মেলনের মাধ্যমে এদেশের সশস্ত্র বিপ্লব নূতন রূপ নেয়। তারা সরকার গঠনের জন্য অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল (পরবর্তীতে জেনারেল) ওসমানীকে (নির্বাচিত সংসদ) রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে সমন্বয় করে ১০ এপ্রিল সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের আ¤্রকাননে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) ওসমানীকে যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক (ঈড়সসধহফবৎ রহ ঈযরবভ) নিযুক্ত করা হয়। অস্থায়ী সরকারের তত্বাবধানে তারই সামরিক নেতৃত্বে ৯ মাস যুদ্ধ শেষে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘঠে। এই নয় মাস সর্বসম্মতভাবে সর্বদলীয় সরকার/বিপ্লবী কাউন্সিল/যুদ্ধ কাউন্সিল ইত্যাদি তৈরীর প্রচেষ্ঠা পূরণ না হলেও তরুন সেনা অফিসারদের অধীনে সেক্টরে বিভক্ত হয়ে নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনী যুদ্ধ পরিচালনা করে।

রাজনৈতিক মতাদর্শ ও যুদ্ধকৌশলের ভিন্নতার কারণে অনেক রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্ব দেশের অভ্যন্তরে এককভাবে যুদ্ধ করেছে যেমন কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি ইত্যাদি। এই দীর্ঘ ৯ মাস সেক্টর কমান্ডাররা তাদের দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় অনিয়মিত যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। দেশপ্রেমিক এই যোদ্ধারা পাকিস্তানের সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিটি পর্যায়ে অভূতপূর্ব ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত রণকৌশল, বীরত্ব এবং যোগ্যতা দেখিয়েছেন যা সামরিক ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় অংশ। তরুণ প্রশিক্ষিত ছাত্রদের ক্রাক প্লাটুন রাজধানী ঢাকাতে যে অপারেশন পরিচালনা করে তা সারা বিশে^ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা তুলে ধরে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই বীরত্বের গল্প তাই আমাদের সামরিক ইতিহাসের এক অসীম সাগরের অংশ যার মাত্র কিয়দংশ উন্মেচিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিমান ও নৌবাহিনী অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে সৃষ্টি হলেও তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে করেছে উদ্ভাসিত।

”অপারেশন জ্যাকপট” এবং বিমান বাহিনীর ”অপারেশন কিলো ফ্লাইট” এখনও লোকগাঁথার মত আমাদের হৃদয়কে করে উদ্বেলিত। ২১ শে নভেম্বর যৌথ অভিযানের মাধ্যমে সুচিত হয় সশস্ত্র বাহিনীর বীরত্ব গাঁথা ও পেশাদারীত্বের এক নূতন চমক। সাংগঠনিক দক্ষতার ক্ষেত্রে যুক্ত হয় নূতন দিগন্ত। এসবই আমাদের সামরিক ইতিহাসের গৌরবজ্জল অধ্যায় এবং বিস্তারিত বিবরন এখনও লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছে । কোন সমন্বিত ধারায় পরিকল্পিত ভাবে এইসব সূত্র সংগ্রহ করা হচ্ছেনা/যাচ্ছেনা । ভারত প্রতিবেশী হিসাবে এই মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে যায়। রাজনৈতিক, সামরিক ও সামাজিক সহায়তা আমাদের মনোবল ও কর্মতৎপরতার গতি বৃদ্ধি করে। ভারত সীমিত সামরিক সহায়তার মধ্যে দিয়ে গড়ে তোলে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিশাল ভিত্তি। সর্বশেষে যৌথ বাহিনীর গঠনের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বরে সুচিত হয় আমাদের ইঙ্গিত লক্ষ্য।

ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ – ভারত যৌথ বাহিনীর কার্যক্রম, নিয়ন্ত্রন, প্রশাসন ইত্যাদি এখনও সামরিক ইতিহাসের একটি বিশাল ভান্ডার। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দেশ হতে সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মানবিক সহায়তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সামরিক ইতিহাসের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ বিষয়ে অনেক অজানা তথ্য আলোতে আনার এখনও সুযোগ রয়েছে। বিদেশের অনেক ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তাকে আমরা এখনও স্মরন করতে পারছিনা শুধুমাত্র যোগাযোগ ও উপাত্ত সংগ্রহের অভাবের কারনে । সামরিক ইতিহাসের একটি বিশেষ বিবেচ্য বিষয় ছিল সামরিক নেতৃত্বের সাথে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্বন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ। এই যুদ্ধ কি স্বাধীনতা যুদ্ধ/মুক্তিযুদ্ধ/বিপ্লব এই ক্রয়ী প্রশ্নের উত্তর সামরিক ইতিহাসকে করতে পারে আরো উন্মুক্ত ও গবেষণার জন্য তা অতি জরুরী বিবেচ্য বিষয়। যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধপরবর্তী বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল ও সকল দলের যৌথ সরকার গঠনের সম্ভাব্যতা এবং বাস্তবতায় স্থান, কাল ও পাত্রের বিভিন্ন প্রকৃতি ও ঘটনাবলীর বিস্তৃত বিবরন আমাদের সামরিক ইতিহাসকে করতে পারে আরো সমৃদ্ধ।

১৯৭১ পরবর্তী বিবিধ ঘটনা সামরিক ইতিহাসকে সমুজ্জ্বল করেছে। জেনারেল ওসমানীর অবসরের পর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ নতুন সেনাপ্রধান হন এবং মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পরিপুষ্ঠ একদল তরুন সেনা অফিসারেরা শুধুমাত্র দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে নতুন স্বশস্ত্রবাহিনী গড়ে তোলার বিশাল গুরু দায়িত্ব নেন । এই নতুন স্বশস্ত্র বাহিনীর গড়ে তোলার ইতিহাস আমাদেরকে করে কৃতজ্ঞ যার বিশালত্ব এখন আমাদের নিকট স্বপ্নপুরীর গল্পের মতন । এই গল্পের নায়ক ও অন্যান্য শিল্পিদের সাথে পঞ্চাশ বৎসর পর নতুন প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করা অতিজরুরী হয়ে পড়েছে । পাকিস্তান হতে বন্দী অবস্থায় থাকা বাঙালি সেনা অফিসার ও সদস্য এবং তাদের পরিবারবর্গের বন্দী দশার করুণ কাহিনী, বিরোচিত ঘৃনার প্রকাশ, পালানোর বীরত্বগাঁথা, স্বল্প সংখ্যক পাকিস্থানি জান্তাদের সহযোগীদের কথা এবং বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি আমাদের সামরিক ইতিহাসের বিসাল ক্যানভাস। দেশে ফেরত আসার পর কিভাবে তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সশস্ত্রবাহিনীতে আত্মীকরণ হয়েছিল তা সামরিক ইতিহাসে সম্পূর্ণভাবে এখনও লিপিবদ্ধ করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের সামরিক ইতিহাসের নতুন সূচনা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষীদের বিদায় হতে হয় অর্থাৎ অসামরিক মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিয়ে তার নিজস্ব কর্মস্থল, লেখাপড়া ইত্যাদিতে ফিরে যায়। তাদের ডিমবিলাইজেশন (উবসড়নরষরুধঃরড়হ) প্রক্রিয়া ও নথিভুক্তকরণ ইত্যাদি সামরিক ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করতে পারে । মৃত ও আহত সতীর্থদের সাথে তাদের আতিœক যোগাযোগ বিষয়কে পরবর্তীতে হয়তো আর কেউ খোঁজ রাখেনি। সামরিক ইতিহাসের এই করুণ অধ্যায়কে যত তাড়াতাড়ি জনসম্মুখে আনা যাবে ততই আমাদের কল্যাণ। কেননা আমরা যে তাদের কাছে অতি ঋণী। যুদ্ধের এই গনযোদ্ধারা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে তাদের অব্যক্ত বক্তব্য এবং বিজয়ের অহংকার নিয়ে । যুদ্ধ পরবর্তীতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থান, তাদের প্রত্যাবর্তন এবং বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সাথে সমন্বয় বিষয়াদি সামরিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল বিষয়। কিভাবে পাকিস্থানী অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, গাড়ী, নথিপত্র ইত্যাদি বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীকে হস্তান্তর করা হয় তাও সামরিক ইতিহাসের অংশ।

স্বাধীনতার পরবর্তীতে রক্ষীবাহিনী গঠন এবং পরবর্তীতে সেনাবাহিনীতে আতœীকরন, কৌশল, বাস্তবতা এবং ফলাফল ইতিহাসের এক বিশাল অধ্যায়। বাংলাদেশে স্বাধীনতা উত্তর সামরিক ইতিহাসের যোগ হয়েছে জাসদ ও বামপন্থীদের স্বশস্ত্র সংগ্রাম, সামরিক বাহিনীর কতিপয় সদস্য কতৃক স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকান্ড ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে যোগসাজস, ০৩ ও ০৭ নভেম্বর রাজনৈতিক পরিমন্ডলে সামরিক বাহিনীর অনুপ্রবেশ, পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ড, সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ কতৃক সামরিক বাহিনীর পুনঃ রাজনীতিতে অংশগ্রহন ও ক্ষমতা পরিত্যাগের নেপথ্য কাহিনী, ১৯৯৬ সালের সেনাপ্রধানের রাজনীতিতে পুনঃ অনুপ্রবেশের ব্যর্থ প্রচেষ্টা এবং ২০০৭ সালে স্বশস্ত্র বাহিনীর রাজনীতিতে প্রবেশ প্রচেষ্টার ইতিবৃত্ত ও ফলাফল নিয়ে সামরিক ইতিহাসের খন্ড খন্ড চিত্র থাকলেও সম্পূর্ন ক্যানভ্যাসের বৃহৎ অংশ এখনও খালি । একথা ভুললে চলবেনা যে নায়ক ও খলনায়ক উভয়ই আমাদের ইতিহাসের অংশ এবং সত্যকে সামনে আনায়নের জন্য উভয়ের আলোচনা সমভাবে গুরুত্বপূর্ন। বাংলাদেশের দক্ষিন পূর্বের পার্বত্য চট্টগ্রামের কাউন্টার ইন্সারজেন্সী অপারশনের সুদীর্ঘ ইতিহাসের খন্ড বিখন্ড চিত্র পাওয়া গেলেও সম্পূর্ন চিত্র এখনও অনাবিস্কৃত ।

স্বশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার এবং বেসামরিক কর্মকর্তা কর্মচারীদের কঠোর পরিশ্রম এবং নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের প্রতিচ্ছবি হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনও বাংলাদেশের অংশ হিসাবে টিকে আছে । অসংখ্য নৃতাত্বিক গৌষ্ঠির সদস্য এবং বাঙ্গালীদের করুন কাহিনী ও আতœত্যাগে সমুজ্জ্বল পার্বত্য চট্টগ্রামের সামরিক ইতিহাস। যেকোন প্রাক্তন বা চাকুরীরত অফিসার ও সৈনিকরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জীবন ও কার্যকলাপ নিয়ে সকল সময় স্মৃতি রোমন্থন করে এবং হতে চায় সামরিক ইতিহাসের অংস । ১৯৭২ সাল হতে ১৯৯৭ পর্যন্ত বাংলাদেশকে কাউন্টার ইন্টারজেন্সি যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়েছে ।

ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৫ বৎসর পার হয়েছে এবং এখনও সময় রয়েছে ইতিহাসের এই অতিগুরুত্বপূর্ন ঘটনাকে সবার সামনে তুলে ধরা । উভয় দলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং সদিচ্ছা থাকলে বাংলাদেশের জনগন শান্তিচুক্তির এই বিশাল ভান্ডার হতে প্রয়োজনীয় উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারবে । যুদ্ধ পূর্ববর্তীতে বিহারী-বাঙ্গালী সংঘর্ষ এবং পাকিস্থান সেনাবাহিনী কর্তৃক কথিত অস্ত্র সরবরাহ সামরিক ইতিহাসের নতুন আলেখ্য । যুদ্ধ পরবর্তীতে মীরপুরে অবাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র উদ্ধার এবং ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টসহ নিরাপত্তা বাহিনীর আতœত্যাগের বর্ননা ধীরে ধীরে স্মৃতির অন্তরালে চলে যাচ্ছে। বিবিধ সময়ে সন্ত্রাসী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী দের বিরুদ্ধে সশস্ত্রবাহিনীর তৎপরতার বিবিধ বিবরন, ত্যাগের তথ্য এবং প্রকৃতি খুবই কম লিখিত আকারে পাওয়া যাবে । এইসব স্থান ও সাথী পাত্ররা এখন অনেকেই স্মৃতির অন্তরালে চলে গিয়েছে । তারা সবাই আমাদের ঐতিহ্যবাহী সামরিক ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্নঅংশ । স্বাধীনতার পর থেকে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড এবং বিশ^ শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ স্বশস্ত্র বাহিনীর অবদান, আত্মত্যাগ এবং দেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে জোরদার করার বিশাল প্রচেষ্টার উপস্থাপন করার জন্য সামরিক ইতিহাসে এক বিশাল ভান্ডার সৃষ্টি হয়েছে ।

এইসব তথ্যকে সমন্বিত করে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ স্বশস্ত্র বাহিনীর নবযাত্র শুরু হতে পারে । এছাড়া সামরিক এ্যটাচীদের সামরিক কূটনীতির সফলতা/ব্যর্থতা সামরিক ইতিহাসকে করতে পারে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর । জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন শেষে দেশে ফেরার পর ঐসব অঞ্চলের সরকার বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর কর্মকান্ডের স্মৃতিচারন ও ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে একটি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক ও সহযোগিতার ক্ষেত্র প্র¯দত করেছে । আমাদের উচিৎ এই তথ্যভান্ডারের সাথে সফল সংযুক্তি যা সামরিক ইতিহাসকে করবে গতিমান । স্বাধীনতার পঞ্চাশ বৎসর পর তথ্যের অভাব পরিলক্ষিত হওয়াটা স্বাভাবিক । এ বিষয়ে এখনও সুযোগ আছে ইতিহাসের সূত্রকে চলমান রাখার । দেশের বিভিন্ন স্থানে বিবিধ স্থাপনা/সরঞ্ছামাদি, জীবিত মুক্তিযোদ্ধা, সাহায্যকারী মুক্তিযোদ্ধা, ঘটনার সাক্ষী, সরকারী ও বেসরকারী নথীপত্র, খবরের কাগজ, সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত ওয়ার ডাইরী ও ডাইজেন্ট অব সার্ভিস, বিদেশী দূতাবাস হতে প্রেরিত রিপোর্ট, বিভিন্ন দেশের সামরিক ও বেসামরিক আর্কাইভ ও মিউজিয়াম, বিবিধ লেখা ও বই ইত্যাদি হতে তথ্য ও উপাত্ত পাওয়া যেতে পারে । এসব তথ্য সংগ্রহের জন্য চাই নিবেদিত প্রান এবং সাহসী একদল যুবক/যুবতী ও তরুন গবেষনাকারী ।

গবেষনার মৌলিক নীতিমালা ও ধাপকে ব্যবহার করে যথোপযুক্ত প্রশাসনিক সুবিধাদি দেয়া গেলে এই নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসকে সর্বোচ্চ ৩-৪ বৎসরের মধ্যে তুলে আনতে পারবে । এক্ষেত্রে দেশের প্রতিটি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের আওতাধীনে কলেজসমূহ অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে । মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রনালয়, যুব মন্ত্রনালয়, শিক্ষা মন্ত্রনালয় এবং সাংস্কৃতিক মন্ত্রনালয় এ বিষয়ে যথোপযুক্ত বাজেট বরাদ্দ করতে পারেন । এছাড়া এফবিসিসিআই এর আওতাধীন বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সিএসআর (ঈঝজ) এর কমপক্ষে ১/১০ অংশ এই কাজে বরাদ্দ করতে পারেন যা বিশ^বিদ্যালয় ও কলেজের সামরিক ইতিহাস গবেষনায় ব্যয়িত হবে । ট্রয় সিনেমায় আগামেমনের চরিত্রে অভিনয় করা ব্রায়ানবক্স বীর সৈনিক অ্যাকিলিসের প্রতি বলেছিলেন “ইতিহাস শুধু স¤্রাটদের মনে রাখে।

সৈনিকদের ঠাঁই ইতিহাসের পাতায় নেই। রোমের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া উদ্দেশ্য। মৃত্যু তার জীবনের লক্ষ্য”। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে লিপিবদ্ধ এই তথ্য ও জ্ঞান আমাদের স্বাধীনতার নিরাপত্তার জন্য অতি প্রয়োজনীয় । আশা করা যায় যে, বিবিধ সূত্র থেকে এইসব তথ্য সংগ্রহের জন্য রাষ্ট্র, সামরিক বাহিনী, বিশ^বিদ্যলয়, মিডিয়া (যেমন দৈনিক বনিকবার্তার সিল্করুট নামক প্রকাশনা), ইতিহাস চর্চার প্রতিষ্ঠান সমূহ এবং ব্যাক্তিগত পর্যায়ে অতি দ্রুততার সাথে পদক্ষেপ নেয়া হবে । বাংলাদেশের স্বশস্ত্রবাহিনী সামরিক ইতিহাসের আলোকে নিজেকে আধুনিকীকরন, দক্ষ এবং যোগ্য করে তুলবে । ফলশ্রুতিতে, সার্বভৌমত্বের প্রতীক এই বাহিনী জনগনকেন্দ্রীক হবে এবং যে কোন পরিস্থিতি নেতৃত্ব প্রদান করে জনগনের আস্থা ও ভালবাসা অর্জন করবে। বিজয়ের ৫০ বৎসর পর এই হোক আমাদের সবার প্রত্যাশা । সামরিক ইতিহাসের তথ্য জ্ঞানে পরিপুষ্ঠ যুবসমাজ ও দেশ বাসী দেশপ্রেমে হোক উজ¦ীবিত । স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ভবিষ্যৎ সারথীরা জেগে উঠুক নতুন দিগন্তের সন্ধানে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.