কেশবপুরে এক ইজিবাইক চালক নিজের শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা

শামীম আখতার, বিভাগ (খুলনা) কেশবপুরে হাবিবুর রহমান রনি (৩৫) নামে এক ইজিবাইক চালক নিজের শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।

এতে তার সমস্ত শরীর আগুনে পুড়ে ঝলসে গিয়ে মারাত্মক আহত হয়ে প্রথমে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এখন তার অবস্থা মোটামুটি ভালো, তবে, আশঙ্কাজনক রয়েছে বলে জানান পরিবারের লোকজন। ডাক্তার বলেছে তার শরীরের প্রায় ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে। ঘটনাটি ঘটেছে গত শুক্রবার (৩১ মে) রাতে উপজেলার শিকারপুর বাজারে। 

 

এলাকাবাসী ও পরিবার সূত্রে জানা গেছে, কেশবপুর উপজেলার শিকারপুর গ্রামের বজলুর রহমান সানার ছেলে হাবিবুর রহমান রনি (৩৫) পেশায় একজন ইজিবাইক চালক। গত শুক্রবার সকালে হাবিবুর রহমান রনির ইজিবাইকে একই গ্রামের জিল্লুর রহমান সরদার ছেলে অপু সরদার (২৫) চড়ে যাওয়ার সময় তার মোবাইল ফোন থেকে ১ হাজার টাকা নিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ওইদিন সন্ধ্যায় শিকারপুর বাজারে শফিকুল ইসলামের ভাজাপোড়ার দোকানের সামনে অপুর কাছ থেকে রনি মোবাইল ফোন নিয়ে চলে যাওয়ার সময় তাদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। উভয়ের হাতাহাতির একপর্যায়ে হাবিবুর রহমান অপু সরদারের ডান কানে থাপ্পড় মারলে সে মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেলে মোবাইল ফোন নিয়ে রনি চলে যায়। পরবর্তীতে স্থানীয় ইউপি সদস্য মনিরুজ্জামান হাবিবুর রহমানের উপর বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে মোবাইল ফোনটি নিয়ে অপু সরদারকে ফিরিয়ে দেয়। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজন অপু সরদারকে প্রাথমিক পর্যায়ে সুস্থ করে কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে ভর্তি করেন। ওইসময় হাবিবুর রহমান রনি ইজিবাইক নিয়ে বাড়িতে চলে যায়। সংবাদ পেয়ে অপু সরদারের মামা বারুইহাটি গ্রামের শাহারুল ও কামরুল মোল্যা (৩৮) সহ আরো দু’একজন মোটরসাইকেলযোগে শিকারপুর বাজারে এসে হাবিবুর রহমানকে খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে রনির বাপ-মা তুলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও হাত-পা কেটে নেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধামকি দিয়ে চলে যায়। পরে হাবিবুর রহমান হুমকি ধামকির বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষোভে, রাগে উত্তেজিত হয়ে বাড়ি থেকে পুনরায় শিকারপুর বাজারে গিয়ে আশরাফুল ইসলাম নয়ন (৩০) এর দোকানে বিক্রয়ের জন্য প্লাস্টিকের বোতলে রাখা পেট্রোল নিয়ে শরীরে ঢালতে ঢালতে চৌরাস্তার দিকে যায় এবং পাশ্ববর্তী বাবু কর্মকারের মুদি দোকান হতে গ্যাস লাইট নিয়ে নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে ছটফট করতে থাকে। ওইসময় বাজারের উপস্থিত লোকজন ও স্থানীয় দোকানদাররা পানি ঢেলে রনির শরীরের আগুন নিভিয়ে ফেলে। ততক্ষণে তার সমস্ত শরীর আগুনে পুড়ে ঝলসে যায়। পরবর্তীতে পরিবারের লোকজন তাকে দ্রুত এম্বুলেন্সযোগে প্রথমে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে গেলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করেন এবং তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন। সে বর্তমানে সেখানেই চিকিৎসাধীন রয়েছে।

সরজমিনে গিয়ে প্রত্যক্ষসাক্ষী শিকারপুর গ্রামের আব্দুস সেলিমের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, রনি ছুটতে ছুটতে শরীরে পেট্রোল ঢেলতে ঠেলতে চৌরাস্তার এসে বাবুর দোকান থেকে গ্যাসলাইট নিয়ে রাস্তার উপরে শরীরে আগুন লাগিয়ে দিলে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। ওইসময় বাজারে উপস্থিত লোকজন ও স্থানীয় দোকানদারেরা পানি ঢেলে নিভিয়ে ফেলে। ততক্ষণে তার সমস্ত শরীর পুড়ে যায়।

একই গ্রামের রফিকুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুক্রবার সকালে তালগাছ কাটার সময় রনির ইজিবাইকে করে অপুকে ভালুকঘরের দিকে যেতে দেখে আমি তাদের দাঁড়াতে বলি। এরপর দুজনেই আমার কাছ থেকে তালের রস খেয়ে সেখান থেকে চলে যায়। 

একই গ্রামের মনিরুল ইসলাম বলেন, শফিকুল ইসলামের ভাজাপোড়ার দোকানে আমার সামনে রনি দাঁড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ রনি এসে অপুর কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নেয় এবং ১ হাজার টাকা দিলে মোবাইল ফেরত দিবে বলে চলে যেতে চাই। ওইসময় অপু বাঁধা দিলে রনি কান পিঠে থাপ্পড় মারলে সে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। আমি তখন তাকে নিয়ে কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করায়। পরে শুনি রনি নিজের শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়েছে।

শিকারপুর বাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রভাত রায় বলেন, অপুকে মারপিট করার পর তার মামা শাহারুল মোল্যা বাজারে এসে রনির বাপ-মা তুলে গালিগালাজ ও বিভিন্ন ধরনের হুমকি ধামকির দেওয়ার বিষয়ে লোকে মুখে শুনেছি। সন্ধ্যার পরে আমার দোকানের সামনে রনি চৌরাস্তায় ছুটে এসে বলে তোরা আমাকে অনেক জ্বালিয়েছিস, আর জ্বালাবো না এই কথা বলেই তার শরীরে আগুন লাগিয়ে দিলে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে।

এছাড়াও এলাকাবাসী শফিকুল, সালামসহ অনেকেই বলেন, রনির মাথায় একটু সমস্যা আছে। তবে, সে কখনো কারো সাথে খারাপ আচরণ করতে দেখা যায় না। তাকে হুমকি ধামকি দেওয়ার কারণে সে হয়তো ক্ষোভে দুঃখে এমন কাজ করেছে।

 

খোলা বাজারে পেট্রোল রাখা দোকানদার আশরাফুল ইসলাম নয়ন বলেন, আমি অনেক আগে দোকানে পেট্রোল বিক্রি করতাম, এখন করিনা। দোকানে পেট্রোল বিক্রি করার আমার কোন লাইসেন্স নেই। বাড়ির মোটরসাইকেলের জন্য কেশবপুর পাম্প থেকে আমি বোতলে পেট্রোল নিয়ে এসে দোকানে রেখেছি, আমি দোকানে না থাকার সুবাদে সেই পেট্রোল রনি নিয়ে গেছে। 

হুমকি ধামকি দেওয়ার বিষয়ে অপুর মামা শাহারল ইসলাম ও কামরুল ইসলামের মুঠোফোনে কথা হলে তারা বলেন, ভাগ্নেকে মারপিটের খবর পেয়ে শিকারপুর বাজারে গিয়েছিলাম কিন্তু রনি ও তার পরিবারের কাউকে কোন প্রকার হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য মনিরুজ্জামান বলেন, অপুকে মারার পর আমি রনিকে বকাঝকা করে তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে অপুকে ফিরেয়ে দিয়েছি। তারপর রনি ইজিবাইক নিয়ে বাড়িতে চলে যায়। পরে শুনি রনি নিজের শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়েছে। অপুর মামারা রনিকে হুমকি ধামকি দিয়েছে কিনা সেটা আমি জানিনা। তবে, অপুর মামা শাহারুল বাজারে এসে ভাগ্নের মারপিটের কথা বলাবলি করছিলো।

 

অগ্নিদগ্ধ রনির পিতামাতা ও পরিবারের লোকজনের সাথে কথা হলে তারা বলেন, ওরা আমার ছেলেকে বকাঝকা ও হুমকি ধামকি দেওয়ার কারণে সে হয়তো ক্ষোভে শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। আমার ছেলের মাথায় একটু সমস্যা আছে। তবে, সে কখনো কারো সাথে ঝগড়াঝাটি করে না। ছেলের অবস্থা বেশি ভালো না, হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। এখনো পর্যন্ত কোথায় কোন অভিযোগ করা হয়নি। তনে, থানায় লিখিত অভিযোগ করা হবে এবং এর সঠিক বিচার চাই।

 

এ ব্যাপারে কেশবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ জহিরুল আলম বলেন, নিজের শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানোর খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। অগ্নিদগ্ধ পরিবারের কেউ এখনো পর্যন্ত অভিযোগ করেননি, অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published.